Image description

জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার পর গোয়েন্দাদের তদন্তে কিলারদের হিটলিস্টে থাকা আরো অনেকের নাম উঠে এসেছে। এই তালিকায় প্রথমে ছিলেন ওসমান হাদি। হিটলিস্টে পরের তালিকায় রয়েছে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। আরো রয়েছে ডাকসু ভিপি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা সাদিক কায়েমসহ অন্তত ১০ জন। তাদের বেশির ভাগই সম্প্রতি ডাকসু, চাকসু ও রাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃবৃন্দ। সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত  প্রতিবেদন

হাদিকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় গোয়েন্দাদের তদন্তে এমন তথ্য উঠেছে। তদন্ত সূত্র অনুসারে, মূলত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করতেই ভারতে বসে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদেরও টার্গেট করে হত্যার মিশন বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। তাদের চ্যালেঞ্জ নির্বাচনকে বানচাল করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে ফেরা। এ লক্ষ্যে বড় ধরনের নাশকতা পরিকল্পনা রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির।

দলটিকে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ার সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। এরই মধ্যে হাদির ওপর গুলি করা সন্দেহভাজন দু’জন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল ও সাবেক যুবলীগ নেতা মো: আলমগীর শেখ জুলাই বিপ্লবের নেতাকর্মীদের সাথে মিশে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচার করেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মোস্ট ওয়ান্টেড ফয়সাল করিমকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানকের সাথে দেখা গেছে। এমনকি নানকের ছবি সংবলিত একাধিক পোস্টারেও ফয়সালের ছবি রয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হাদি ছাড়াও আরো যারা হিটলিস্টে আছে- কিলাররা তাদের আশপাশেই রয়েছে। জানা গেছে, হাসনাত ও সারজিসদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেখা গেছে ফয়সালকে। ওই অনুষ্ঠানে ভিডিও কলে ব্যবসায়ী বন্ধুদের বলেছেন ‘এই যে হাসনাত ও সারজিস ভাইয়ের সাথে। যেহেতু ফয়সালের অ্যাপল সফট আইডি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে যে ৩০টি চেকের পাতা স্বাক্ষরিত অবস্থায় উদ্ধার করেছে র‌্যাব ওই চেকগুলো মধ্যে রয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের ও ব্র্যাকব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের চেকের পাতা। তবে কোনও টাকার অঙ্ক বসানো ছিল না।

গোয়েন্দারা বলেন, ছদ্মবেশে কিলাররা মিছিল মিটিংয়ে ঢুকবে এমন আরো চাঞ্চল্যকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর পরিকল্পনা করেছে নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীরা।

এ দিকে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনার তিন দিন পর গত রোববার রাতে পল্টন থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ফয়সাল করিমকে। এ ছাড়াও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ রয়েছে। মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয়েছে ডিবিকে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীদের আটক করা হলেও হাদি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে বান্ধবী মারিয়া হ্যাপীর কাছে ফয়সাল ও আলমগীরের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য থাকায় তাকে এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।

হাদিকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনা যেভাবে : তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ওসমান হাদির ওপর হামলার পরিকল্পনা ঠিক কত দিন আগে নেয়া হয়েছে তা এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে বান্ধবী মারিয়ার সাথে ফয়সালের সম্পর্ক গত অক্টোবর মাস থেকে। এই দুই মাসে মারিয়াকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ও কয়েকটি বাড়িতে রাতযাপন করেছে সে। গত মঙ্গলবার ও বুধবার আলমগীর এবং ফয়সালের সাথে সাভারের একটি রিসোর্টে ছিলেন তারা। ওই রিসোর্টে বসেই হাদিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আলমগীর শেখ ফয়সাল করিম যখন হত্যার পরিকল্পনা করে তখন ভারতে কয়েক দফা কথা হয় ফয়সালের। কিলিং মিশন সফল হওয়ার পর তারা কিভাবে সেখান থেকে পালাবেন তারও একটা আগাম পরিকল্পনা ছিল।

পরিকল্পনামাফিক বৃহস্পতিবার সকালে মারিয়াকে নিয়ে আগারগাঁওয়ের একটি বাসায় আসেন তারা। ওই দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে একটি উবারে করে সাভারের ওই রিসোর্টে যান মারিয়া, ফয়সাল আলমগীর ও মারিয়ার ছোট বোন। সেখানে তারা পৌঁছান ভোর ৫টা ২ মিনিটে। মারিয়ার ভাষ্যমতে ওই সময়টায় ফয়সাল ও আলমগীর ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে তারা পরিকল্পনা করে ঘটনা যা করতে হবে আজই। তারা ভারতের কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করছিলেন। কাজ শেষ করে তারা কোন বর্ডার দিয়ে ভারতে পালাবেন তার নির্দেশনাও দেয়া হয় পার্শ¦বর্তী দেশটি থেকে। তবে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তা ধারণা করলেও- শুক্রবার যে হত্যা প্রচেষ্টার মতো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করতে পারেনি মারিয়া। রিসোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে আলমগীরকে সব মোবাইল বন্ধ করতে বলেন ফয়সাল। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা মোবাইল বন্ধ রাখেন।

এরপর সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে তারা উবার নিয়ে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে আগারগাঁওয়ে মারিয়াকে নামিয়ে দেন। পথে মারিয়ার কাছে ফয়সাল মোবাইলের সিমকার্ড চায়। কিন্তু মারিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তা দেননি। পরে ফয়সাল মারিয়াকে বড় একটি লেনদেন ও রোববার ভারতে চলে যাওয়ার কথা জানায় এবং তাকে ১২ হাজার টাকা দেয়। আরো ৩০ হাজার টাকা পরে দেয়ার কথা বলে চলে যায় ফয়সাল।

গোয়েন্দারা তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন সিসিক্যামেরা বিশ্লেষণ করে দেখেন, শুক্রবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে ওসমান হাদির সাথে প্রথম মতিঝিল এলাকায় দেখা করেন ফয়সাল ও আলমগীর। তখন থেকেই প্রচারণায় নামে দুই মোস্ট ওয়ান্টেড ফয়সাল ও আলমগীর। পরে সুযোগ বুঝে তারা বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে গুলি করে পালিয়ে যায়।

৫ দিনের রিমান্ডে ৩ জন : এ দিকে ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুলের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক (সামিয়ার ভাই) ওয়াহিদ আহমেদ, অপর আসামি ফয়সালের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মারিয়া আক্তারের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ আসামিদের আদালতে হাজির করে অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। পরে শুনানি শেষে আদালত তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে রোববার রাতে পল্টন থানায় ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।

মামলায় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, হত্যাচেষ্টা, বিপজ্জনক অস্ত্র ব্যবহার করে স্বেচ্ছায় গুরুতর আঘাত, দুষ্কর্মে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার এজাহারে বাদি উল্লেখ করেন, আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুলসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা তৎকালীন সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে যুক্ত ছিল। তারা হত্যা, গুম ও খুনের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থান প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল। তবে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণমানুষের অংশগ্রহণে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শরিফ ওসমান হাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিনি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গঠন করে এর মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দেন। এ কারণে তিনি সংগঠনটির বিরোধিতার মুখে পড়েন এবং একাধিকবার হত্যার হুমকি পান।

এজাহারে আরো বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই শরিফ ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ১২ ডিসেম্বর বেলা আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে মতিঝিল মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে প্রচারণা শেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাওয়ার পথে পল্টন থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডে তাকে বহনকারী অটোরিকশায় মোটরসাইকেলে থাকা দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়।

সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, হেলমেট পরিহিত দুই সন্ত্রাসী মোটরসাইকেলে এসে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনার সময় একই অটোরিকশায় থাকা তার ভাই ওমর বিন হাদি (৩১) ও অন্যান্য সহকর্মীরা ফুটেজ দেখে আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদকে শনাক্ত করেন। এজাহার অনুসারে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা, প্রার্থীদের মনোবল দুর্বল করা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়। ঘটনার পর আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়।

মামলা ডিবিতে হস্তান্তর : ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় মামলাটি ডিবি মতিঝিল বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে একজনের নাম দেয়া হয়েছে। সোমবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মামলাটি ডিবি মতিঝিল বিভাগ তদন্ত করবে।

সীমান্তে ফিলিপের ২ সহযোগী আটক : শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় সীমান্ত থেকে মানুষ পারাপারে সহায়তাকারী ফিলিপ স্নালের দুই সহযোগীকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সোমবার সন্ধ্যায় বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান। আটকরা হলেন : ফিলিপের মামাশ্বশুর বেঞ্জামিন চিরান (৪৫) ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু সীশল (২৮)।

শরীফুল ইসলাম বলেন, ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনায় সীমান্তে সতর্ক বিজিবি। এরই ধারাবাহিকতায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্ত থেকে মানুষ পারাপারে সহায়তাকারী ফিলিপের দুই সহযোগীকে আটক করা হয়।আস