Image description

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দুপুরের পর বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত ও উদ্বেলিত মানুষের স্রোত ঢাকায় পৌঁছে। সাধারণ মানুষ তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। কেউ স্লোগান দিচ্ছে, কারও চোখে আনন্দঅশ্রু, কেউ ঘরে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে।

এ দিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আলোচনার জন্য দুপুর ১টার দিকে হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী ও জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি জন কেলি তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে (ভারতীয়) নিয়ে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দফতরে পৌঁছান। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে যান জেনারেল আরোরাসহ অন্যদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে।

জেনারেল নিয়াজির অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ্য করেন, নিয়াজি আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবি ভাষায় পরস্পরকে একটির পর একটি স্থূল ও আদি রসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক।

নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল জি সি নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি— যেমন গার্ড অব অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন।

এর পর দুপক্ষের মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান। খসড়া কপি জেনারেল নিয়াজিকে দেন। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিল, আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধবিরতি হবে। আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। জেনারেল ফরমান আলী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দেন। জেনারেল নিয়াজি দলিলটি অন্যদের দেখার জন্য দেন। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেন।

দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশকিছু শর্ত ছিল। যেমন- পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সব বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ ছিল, যা আগে কখনো কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাকিস্তানিরা আরও কিছু সময় নেওয়ার পর আত্মসমর্পণের দলিলে সম্মতি দেয়। এর পর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হয়।

জেনারেল জ্যাকব জানান, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল আরোরাকে গার্ড অব অনার দেবেন। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল সই হবে এবং জেনারেল নিয়াজী তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করবেন।

আত্মসমর্পণের পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজি গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে জেনারেল নিয়াজি সবই মেনে নেন। তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চান।

সাধারণত বিজিত সেনাপতি বিজয়ী সেনাপতির সদর দফতরে গিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে সই দেন ও অস্ত্রসমর্পণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। এখানে বিজয়ী সেনাপতি বিজিত সেনাপতির এলাকায় গিয়ে জনসমক্ষে অত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।

হেলিকপ্টারে করে পড়ন্ত বিকেলে জেনারেল আরোরাসহ মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার, বীরউত্তম তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তারা দেখেন, সেখানে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জ্যাকব এবং আরও কিছু পাকিস্তানি ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা তাদের অভ্যর্থনা জানান। এর পর জিপে করে তারা রমনা রেসকোর্স ময়দানে রওনা হন। সে সময় রমনার চারপাশে ছিল মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে তারা উপস্থিত হন রেসকোর্স ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানে। অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর। অল্প সময়েই শেষ হয়।

অনুষ্ঠানস্থলে ছিল মাত্র দু’টি চেয়ার আর একটি টেবিল। একটি চেয়ারে বসেন জেনারেল নিয়াজি, অন্যটিতে আরোরা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি খুব সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি। মানুষের ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল। এ কে খন্দকার বীরউত্তম, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। জেনারেল আরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন এ কে খন্দকার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায় ছিলেন তার পেছনে, যদিও ভিড়ের চাপে তারা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলেন না।

আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসার পর প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী ও পরে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা দলিলে সই করলেন। সইয়ের জন্য নিয়াজিকে কলম এগিয়ে দেন আরোরা। প্রথমে কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। আরোরা কলমটি নিয়ে ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজীকে দেন। এ দফায় কলমটি আর ঝামেলা করেনি। সই শেষ হলে উভয়ই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজী নিজের রিভালবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্ণচিত্তে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করেন।

এরপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বিজয় সূচিত হয়।