ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টাকারী ফয়সাল করিম মাসুদকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে ২০২৪ সালের ৮ই নভেম্বর বিদেশি পিস্তলসহ ফয়সালের গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে আসার খবর। দুটো অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রাখার মামলায় মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে কীভাবে জামিন পায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এই নেতা।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি সমালোচনার খোরাক হওয়া ওই শুটারের মামলার নথিপত্র মানবজমিনের হাতে এসেছে। এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের (ডিএজি) কাছে শুটার মাসুদের জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেছিলেন কিনা- এ বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। গতকাল ডিএজি চিঠির জবাব ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কোর্টের ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল জবাব ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, তারা জামিনের বিরোধিতা করেছেন। আপিল করতে নোটও অ্যাটর্নি অফিসে জমা দিয়েছেন। কিন্তু নোট জমা দেয়ার বিষয়টি নথিপত্রে পাওয়া যায়নি। আদালত সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের পর পরই সিএমএম আদালতে জামিনের চেষ্টা করে মাসুদ। ব্যর্থ হয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। উভয় আদালতই জামিন না মঞ্জুর করেন। পরে শুটার ফয়সাল করিম মাসুদের স্বজনরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে বিভিন্ন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হঠাৎ করেই নিম্ন্ন আদালতের আইনজীবী সোহাগ হোসেন রনির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের আইনজীবী মো, মাহফুজুর রহমানের সন্ধান পান। আইনজীবীর কথামতো ফাইল করেন মাহফুজুর রহমান। এরপর চলতি বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর বেঞ্চে শুটার মাসুদের জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট কায়সার কামাল। আর তাকে সহযোগিতা করেন এডভোকেট মো. মাহফুজুর রহমান।
শুটার মাসুদের জামিনকারী আইনজীবী হিসেবে বিএনপি’র আইন সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এবং বিএনপি’র সাবেক ছাত্রদল নেতা মো. মাহফুজুর রহমানের নাম আসলেও তারা দু’জনেই জামিন করানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন।
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মানবজমিনকে বলেন, দেশে-বিদেশের বিভিন্ন চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, এসব বিষয়ে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। গুজবের বিষয়ে কিছু বলার নেই। কোনো বিষয়ে ভেরিফিকেশন করতে হলে সার্টিফাইড কপি লাগে। ফেসবুকে যে কপিটা ঘুরছে, আমি যতটুকু দেখেছি ওখানে নামের বেমিল আছে। তিনি বলেন, গত ১৫/২০ বছর ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন করেছি। জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, গণঅধিকবার পারিষদ, হেফাজতসহ বহু ক্রিয়াশীল দলের হাজার হাজার নেতা কর্মীর মামলার জামিন করিয়েছি। সেগুলো নিয়ে তো কখনো কিছু বলে না। বছরের পর বছর নিজে নির্যাতিত হয়ে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কারাগারে যাওয়া বহু লোকজনের বিনা পয়সায় জামিন করিয়েছি। এখন নির্দিষ্ট কেউ হয়তো এজেন্ডা নিয়ে এসব প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।
অপর আইনজীবী এডভোকেট মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, নিম্ন আদালতের সোহাগ হাসান রনি নামে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে এই মামলাটা আমার কাছে আসে। মামলটা পাওয়ার পর আমি ফাইল করি। কিন্তু কিছুদিন পর ওই আইনজীবী আমাকে দ্রুততম সময়ে জামিন করিয়ে দিতে তাড়া দেন। আমি তাকে ৬ মাসের আগে জামিন করানো যাবে না বলে জানাই। পরে তিনি আমাকে ফাইলটা দিয়ে দিতে বলেন। একদিন তিনি ফাইলটা নেয়ার জন্য একজন লোক পাঠান। আমি ওই লোকের কাছে মামলার এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) দিয়ে দেই। তিনি বলেন, আসলে এই মামলার আসামি ফয়সাল করিম মাসুদের জামিন আমি করাইনি। কে করেছে, সেটাও আমার জানা নেই।
দুর্ধর্ষ একজন শুটার এতো অল্প সময়ে কীভাবে জামিন পেলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে আসামির যেন জামিন না হয় সে বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেছিল। আমরা জামিনের বিরোধিতা করেছি। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।
যে কারণে নিম্ন আদালতে জামিন হয়নি: সিএমএম আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে শুটার মাসুদের জামিন চাওয়া হলে উভয় আদালতই তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। মহানগর দায়রা জজ আদালত তার জামিন না মঞ্জুরের আদেশে বলেন, মূল মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অবৈধ লাইসেন্সবিহীন ও গুলি নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯/১৯(এ) ধারাধীনে মূল মামলাটি রুজু হয়। আসামি দরখাস্তকারী মূল মামলায় এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি। এই আসামির দেখানো মতে তার ভাড়াধীন ফ্ল্যাটের বসার রুমের কাঠের কালো সোফার নিচে একটি সাদা রঙের শপিং ব্যাগের ভিতর হতে ৪ রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি ৮.৫ বোরের বিদেশি পিস্তল ম্যাগাজিন সংযুক্ত এবং ০১ (এক) টি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ বর্ণিত অপরাধ গুরুতর ও জামিন অযোগ্য। আসামিকে সম্প্রতি ধৃত করা হয়েছে। মূল মামলাটির তদন্ত চলমান। উল্লিখিত অবস্থাদি বিবেচনায় আসামি দরখাস্তকারী ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলকে জামিনে মুক্তি প্রদান করা সমীচীন হবে নাÑ মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তার জামিন নামঞ্জুর করা হলো।