হঠাৎ করেই কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেশের ভেতরে সেই রোগের যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব নয়। প্রতিটি মিনিট তখন অমূল্য, কারণ সময়ই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। এমন সংকটময় মুহূর্তে যখন স্থলপথে বা সাধারণ বিমানে রোগী পরিবহন অসম্ভব বা ঝুঁকিপূর্ণ, ঠিক তখনই রানওয়েতে অবতরণ করে একটি বিশেষায়িত বিমান। বিমানের ভেতরে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ব্যবস্থা, আধুনিক ভেন্টিলেটর, জীবনরক্ষাকারী মনিটর এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল। এটি কোনো সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান নয়—এটি একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো জীবন রক্ষা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুতর ও জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে দ্রুত ও নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে এই বিশেষ পরিষেবাটি সম্পর্কে এখনও অনেক মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই। বিশেষ করে আকাশপথে যাতায়াতের সময় রোগীর চিকিৎসা কীভাবে চালু রাখা হয়, সেই বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা। তাই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসলে কী, এর ভেতরে কী ধরনের চিকিৎসা সুবিধা থাকে এবং এটি কীভাবে কাজ করে—সেসব বিষয় জানা জরুরি।
এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ধারণাটি নতুন নয়। বিশ শতকের শুরুতে সামরিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ছিল এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। যদিও বর্তমান সময়ে বিষয়টি আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়, তখন আকাশপথে রোগী পরিবহনের ধারণা ছিল অত্যন্ত কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। সামরিক বাহিনী, সরকারি কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক সমাজ এমনকি সাধারণ মানুষও একে অনেকাংশে অবাস্তব ও বিপজ্জনক বলে মনে করত।
এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পেছনে অনেকেই কাজ করেছেন। তবে যার অবদান সবচেয়ে গভীর ও প্রভাবশালী, তিনি হলেন ফ্রান্সের মারি মারভাঁ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন অসাধারণ ক্রীড়াবিদ, ফ্রি বেলুন পাইলট, প্রশিক্ষিত সার্জিক্যাল নার্স এবং বিশ্বের তৃতীয় নারী ফিক্সড-উইং বিমানচালক। নিজের বহুমাত্রিক দক্ষতা ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ধারণাকে বাস্তব ভিত্তি দেন।
মারি মারভাঁ আকাশপথে রোগী সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ছিলেন সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা একজন চিন্তাবিদ। ১৯১২ সালেই তিনি কেমন ধরনের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করা যেতে পারে এবং এর ভেতরে কী কী চিকিৎসা সুবিধা থাকা প্রয়োজন—সে বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেন। সেই সময়ে এই ধারণা ছিল প্রায় কল্পবিজ্ঞানের মতো। পরবর্তী জীবনে তিনি এই ভাবনাকে সামরিক ও বেসামরিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। জীবদ্দশাতেই তিনি দেখতে পান, তার কল্পনা বাস্তবে রূপ নিয়ে বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ইতিহাসে তার নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
বর্তমানে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো হেলিকপ্টার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, অন্যটি হলো ফিক্সড-উইং এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বা মেডিক্যাল জেট। রোগীর শারীরিক অবস্থা, যাতায়াতের দূরত্ব এবং ভৌগোলিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই দুই ধরনের সেবা ব্যবহার করা হয়।
হেলিকপ্টার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অত্যন্ত দ্রুত সাড়া দিতে সক্ষম এবং জরুরি মুহূর্তে তাৎক্ষণিক উদ্ধারকাজে এর জুড়ি নেই। পাহাড়ি অঞ্চল, দুর্গম এলাকা বা যেখানে সাধারণ বিমানের অবতরণ সম্ভব নয়, সেখানে হেলিকপ্টার সহজেই পৌঁছাতে পারে। হাসপাতালের হেলিপ্যাড কিংবা প্রয়োজনে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছিও এটি নামতে পারে। তবে এর গতি ও দীর্ঘপথ অতিক্রমের সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে সীমিত।
অন্যদিকে ফিক্সড-উইং এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সাধারণত বিশেষভাবে প্রস্তুত মেডিক্যাল জেট বিমান। এসব বিমান দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে রোগী স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর। উচ্চ গতি ও দীর্ঘ পাল্লার কারণে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা পরিবহনে এ ধরনের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে এগুলোর জন্য রানওয়ে প্রয়োজন হওয়ায় দুর্গম স্থানে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
হেলিকপ্টার হোক কিংবা ফিক্সড-উইং বিমান—উভয় ধরনের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সেই থাকে উন্নতমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল টিম। এসব বিমানের ভেতরে রোগীকে আইসিইউ-এর সমমানের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, যাতে পুরো যাত্রাপথজুড়ে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল রাখা যায়।
এয়ার অ্যাম্বুলেন্সকে প্রায়ই “উড়ন্ত আইসিইউ” বলা হয়। কারণ এটি কেবল রোগী পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ইউনিট। রোগীর অবস্থার ওপর ভিত্তি করে যন্ত্রপাতি নির্বাচন করা হলেও সাধারণভাবে এখানে থাকে বিশেষ স্ট্রেচার ও ভ্যাকুয়াম ম্যাট্রেস, যা উড্ডয়নের সময় ঝাঁকুনি ও চাপ থেকে রোগীকে সুরক্ষা দেয়।
এছাড়া বিমানে থাকে বিপুল পরিমাণ মেডিক্যাল অক্সিজেন—প্রায় ছয় হাজার লিটার পর্যন্ত। দীর্ঘ ফ্লাইটের জন্য অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার যুক্ত করা হয়, যাতে কোনো জরুরি অবস্থায় অক্সিজেনের অভাব না হয়। মাল্টিপ্যারামিটার মনিটরের মাধ্যমে সারাক্ষণ রোগীর হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করা হয়।
শ্বাসকষ্ট বা জটিল শ্বাসপ্রশ্বাস সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য থাকে উন্নত ভেন্টিলেটর। হৃদরোগীদের জন্য রাখা হয় ১২-চ্যানেল ইসিজি সিস্টেম। পাশাপাশি পালস অক্সিমিটার, ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার, ডিফিব্রিলেটর ও এক্সটারনাল পেসমেকারের মতো জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রও মজুত থাকে। আকাশে থাকলেও পৃথিবীর যেকোনো হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয় স্যাটেলাইট ফোন।
এসবের পাশাপাশি জরুরি ওষুধ, বিশেষ স্ট্রেচার বেড এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকদের একটি দল সার্বক্ষণিকভাবে রোগীর পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকে। পুরো যাত্রাপথেই রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চালু রাখা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের অনেক সময় ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা ইউরোপের উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানো হয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে। তবে দেশে এই পরিষেবা এখনও সীমিত এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়, যার জন্য সরকারি অনুমোদন ও মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ প্রয়োজন হয়।
সবশেষে বলা যায়, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কেবল একটি বিমান নয়। এটি হলো প্রযুক্তি, আধুনিক চিকিৎসা এবং মানবিক দায়িত্বের এক অনন্য সমন্বয়—যা সময়ের সঙ্গে লড়াই করে মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজ করে। ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে নিজস্ব ও বিস্তৃত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাহলে জরুরি চিকিৎসা সেবায় দেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে।