ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় শুটার ও তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলের চালকসহ কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেওয়া অন্তত পাঁচজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা, হয়নি মামলাও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, হাদির মাথায় গুলি চালানো শুটার ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খানই তাদের মূল টার্গেট। পরিচয় শনাক্তের পর তাকে গ্রেপ্তারে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর অন্তত পাঁচটি জায়গায় অভিযানও চালায় পুলিশ, র্যাবসহ গোয়েন্দারা। তবে বারবার স্থান পরিবর্তন করায় তাকে গ্রেপ্তারে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অন্তত চারজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির কিডনির কার্যক্ষমতা ফিরেছে, তবে সার্বিকভাবে তার শারীরিক অবস্থা এখনো ‘অত্যন্ত আশঙ্কাজনক’ বলে জানিয়েছে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন শুক্রবার দুপুরে গণসংযোগ শেষে রিকশায় করে ফেরার পথে রাজধানীর পল্টনের কালভার্ট রোড এলাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। হাদির রিকশাকে অনুসরণ করা একটি মোটরসাইকেলে চালকের পেছনের আসনে বসে থাকা শুটার হাদির মাথায় গুলি করে। এ সময় মোটরসাইকেলে থাকা দুজনেরই মাথায় ছিল হেলমেট। হাদিকে গুলি করার পরপরই তারা পালিয়ে যায়। অন্যদিকে, মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই এখন তার চিকিৎসা চলছে।
হাদিকে গুলি করার স্থান, সময় ও ধরন বিশ্লেষণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করা হয়। একটি মাত্র গুলি খরচ করে হাদিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা প্রমাণ করে এটি সাধারণ কোনো হামলা নয়। পুলিশের ধারণা, গত শুক্রবার হাদির ওপর বন্দুক হামলার আগে থেকেই তার সব শিডিউল, সহচরদের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা নিয়েছে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই। এখানে কেউ করেছে তথ্য দেওয়ার কাজ, কেউ অস্ত্র বহন করেছে, আবার কেউ ছিল ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে।
গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবি পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া একাধিকজনকে তারা শনাক্ত করেছে। এ ঘটনায় মূল সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাকে অল্প সময়ের মধ্যে ধরতে না পারলে অবৈধভাবে সীমান্ত পারি দিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। মূল সন্দেহভাজনকে ধরতে পারলে বাকিদের ধরতে বেশি বেগ পেতে হবে না।
গতকাল সন্ধ্যায় ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘মূল সন্দেহভাজনকে ধরতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এজন্য সবার সহযোগিতা দরকার।’
কিলার দলের সদস্যরা হাদির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন: হাদিকে হত্যাচেষ্টা জড়িত পাঁচজন সাম্প্রতিক সময়ে তার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন বলে তথ্য মিলছে। হাদির রাজনৈতিক সহচর ও ইনকিলাব মঞ্চের আরেক মুখপাত্র নাঈম ইবনে জহির এ বিষয়ে বলেন, ‘ফয়সাল, রুবেল ও জাহাঙ্গীর নামে তিনজন গত দুই শুক্রবার হাদি ভাইয়ের সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে ছিলেন। গত ৫ ডিসেম্বর ফয়সালসহ বাকিরা ইনকিলাব মঞ্চের অফিসে আসেন। তারপর হদি ভাইকে বলেন, আমরা আপনার সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে থাকতে চাই। হাদি ভাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের দলে নেন। ৫ তারিখের পর গত শুক্রবার দ্বিতীয়বারের মতো তারা গণসংযোগে এসেছিল।’
আদাবর-শ্যামলীর চিহ্নিত অস্ত্রবাজ ফয়সাল: হাদির ওপর গুলি চালানো শুটার হিসেবে যাকে শনাক্ত করা হয়েছে, সেই ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হয়েছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের কেশবপুর ডিগ্রি কলেজ লাগোয়া ২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। তার বাবার নাম হুমায়ুন কবির। মায়ের নাম হাসি বেগম। তবে গ্রামের বাড়িতে ফয়সালের পরিবারের কেউ এখন আর থাকে না। অন্তত ৫০ বছর আগে তার পরিবার গ্রাম ছাড়ে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ১০-১২ বছর আগে ফয়সালের বাবা গ্রামে গিয়ে তাদের বসতঘরটি বিক্রি করে দিয়ে চলে আসেন।
জানা যায়, গত সরকারের আমল থেকেই রাজধানীর আদাবর, রিংরোড, শ্যামলী এলাকায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াত সে। তার সঙ্গে সব সময় থাকত একটি স্বয়ংক্রিয় রিভলবার। এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও কিশোর গ্যাং পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদাবর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ছিল তার নিয়মিত আড্ডা। সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করত এলাকায় তার যাবতীয় কার্যক্রম। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের অভিযোগে আদাবর থানায় একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলার প্রধান আসামি ছিল ফয়সাল। মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। তখন তার কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, তিনটি মোবাইল ফোন ও ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পায় ফয়সাল। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত ফয়সাল পরিবার নিয়ে আদাবরের পিসি কালচার হাউজিংয়ে ভাড়া বাসায় থাকত। গতকাল সেই বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফয়সাল টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পরিবার বাসাটি ছেড়ে দেয়। সেই বাড়ির বাসিন্দাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফয়সালের পরিবার এই বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর মিরপুরের দিকে বাসা নেয়। ফয়সালের এক সময়ের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে ফয়সালের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ফলে স্থায়ীভাবে সে কোথাও থাকে না। জামিনে বের হওয়ার পর পুলিশের নজর এড়াতে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলত। এর আগে ২০২২ সালে সিগারেট এনে দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় এক রেস্তোরাঁ কর্মীকে ফয়সাল সঙ্গে থাকা পিস্তল দেখিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা: নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। এ ঘটনায় জড়িতদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এই ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এ হামলায় জড়িত কাউকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে আমরা জনগণের কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পাব বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি। ওসমান হাদির ওপর আক্রমণের ঘটনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস বলে আমরা মনে করি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যে কোনো অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।’ এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট-টেররিস্টদের দমনের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালু করা হবে বলেও জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
হাদিকে গুলি করা সন্দেহভাজনকে ধরতে সীমান্তে বিজিবির কড়া নজরদারি-তল্লাশি: হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিরাপত্তা ও তল্লাশির কাজ জোরদার করেছে বিজিবি। এ ছাড়া লালমনিরহাট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তেও নজরদারির খবর পাওয়া গেছে। যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন জানায়, সীমান্তের মেইন পিলার ১৮/১ এস থেকে ৪৭/৩ এস পর্যন্ত প্রায় ৭০.২৭৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কড়া তল্লাশি চলমান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। রয়েছে অতিরিক্ত বিজিবি। সীমান্তের যে স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নেই, সে স্থান সিলগালা করা হয়েছে।
কিডনির কার্যক্ষমতা ফিরলেও হাদির অবস্থা এখনো ‘অত্যন্ত আশঙ্কাজনক’: রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির শারীরিক অবস্থা এখনো ‘অত্যন্ত আশঙ্কাজনক’। তবে হাদির কিডনির কার্যক্ষমতা ফিরে এসেছে। এ ছাড়া রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা (ডিআইসি) অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত রয়েছে। এভারকেয়ার হাসপাতালে হাদির চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে গতকাল আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তার সর্বশেষ শারীরিক এই অবস্থার কথা জানানো হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রয়েছেন। তার মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে গুরুতর আঘাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।