Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সকল ধরনের গুঞ্জনের অবসান ঘটেছে। রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের গত কয়েক মাসের তর্ক-বিতর্ক ও শঙ্কা পেরিয়ে নির্বাচনি ট্র্যাকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট।

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তফসিল ঘোষণার সময় এ তথ্য জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।

সিইসি বলেন, ‘আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ (বৃহস্পতিবার) ৩০০ আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ সাধারণ নির্বাচন এবং একইসঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ আগামী ২৯ ডিসেম্বর (সোমবার), মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৩০ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) থেকে ৪ জানুয়ারি (রবিবার) পর্যন্ত। রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়েরের শেষ তারিখ ১১ জানুয়ারি (রবিবার)। কমিশনে দায়ের করা আপিল নিষ্পত্তির তারিখ ১২ জানুয়ারি (সোমবার) থেকে ১৮ জানুয়ারি (রবিবার) পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি (মঙ্গলবার)।’

রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ ২১ জানুয়ারি (বুধবার)। নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হবে ২২ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) থেকে ভোটগ্রহণ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত প্রচারণা চালানো যাবে।

সিইসি আরও বলেন, ‘নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ ভোটারদের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করছি। সবার প্রতি আমার আহ্বান আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সফল করে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখুন।’

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে তফসিল নিয়ে যা বলছেন সুশীল সমাজ

তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রথম ধাপ শুরু হলেও সুশীল সমাজের কেউ কেউ আদৌ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ সকল শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই সরকারের মূল তিনটি লক্ষ্য ছিল। নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার। সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া কতটুকু কী হয়েছে তা দৃশ্যমান। আপাতত তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের যাত্রা শুরু হলেও আদৌ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’

সুজন সম্পাদক আরও বলেন, ‘কেবল তো নির্বাচনের প্রাথমিক ধাপ। এরপর মনোনয়ন, রাজনৈতিক দলের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা ওসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কতটুকু সাহসিকতার সঙ্গে আইনকানুন বা বিধিমালা অনুযায়ী কাজ করতে পারে সেটি দেখার বিষয়। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে না।’

শিক্ষক নেটওয়ার্কের কাজী মারুফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বরাবরই বলে আসছি নির্বাচন হবে। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে যেসব দুর্বল জায়গা আছে তা নিরসন হবে। এর মাধ্যমে যেসব জায়গায় ধীরগতিতে কাজ হচ্ছে সেখানে গতিশীলতা ফিরবে। আমি নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক। আমি আশা করি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, অন্তর্বর্তী প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ বা জেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশবাসীর প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর গতানুগতিক যে ধারা বিশেষ করে অর্থ, পেশি ও ধর্মের ব্যবহার, এটা থেকে দূরে রাখতে হবে। তবেই মানুষের বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে।’

তফসিল ঘোষণায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তবে দলীয় চাপের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থায় এ নির্বাচন করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে এনসিপি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিলকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘তফসিলের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশ একটি কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। আমরা আশা করি নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। সুযোগ এসেছে নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ প্রতিষ্ঠা করার।’

তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি মনে করে এতে নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের অবসান হয়েছে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ। আমরা মনে করি এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেটে গেছে।’

তফসিল ঘোষণা করায় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একইসঙ্গে দলীয় চাপের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থায় এ নির্বাচন করা যাবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে দলটি।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনে ইসির সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন নেই। তবে বিগত দিনের কর্মকাণ্ডে মনে হয় নিরপেক্ষতার অভাব আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পেশিশক্তি ও টাকার প্রভাব আশঙ্কা করছি। এ ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে জনগণের পাহারা দিতে হবে।’

তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। নেতারা বলেন, ‘আমরা আশা করি তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ নির্বাচনের পথ সুগম হবে।’

একইভাবে নির্বাচন কমিশনকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি শাইখুল হাদিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। নেতারা বলেন, ‘আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন হবে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশ ও জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা

এবার দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন ও নারী ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪ জন। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হয়েছে, তাদের নিয়েই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।