শুরুর আগেই এখন ভাঙছে সংসার। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই বহু সংসার ভেঙে যাচ্ছে। চারদিকে যেন মহামারির মতো সংসার ভাঙার হিড়িক পড়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় গত তিন বছরে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট ৪৭ হাজার ৫৭৪টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ২০২৩ থেকে শুরু করে ২০২৫ এই তিন বছরে প্রতি বছরই বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে বিচ্ছেদের হার দক্ষিণের চেয়ে বেশি। আর নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ করছেন। সাধারণত যারা নতুন বিয়ে করছেন এবং বিয়ের বয়স বছর খানেক থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের কম তারাই বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করছেন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিবাহ বিচ্ছেদের বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এগুলো হলো- শ্বশুর-শাশুড়ির নেতিবাচক আচরণ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপোড়ার অভাব, পারিবারিক কলহ, সহনশীলতা কমে যাওয়া, সংসার করার প্রস্তুতির অভাব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, পরকীয়া, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়া। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে নারীরা মোটা অঙ্কের দেনমোহর আদায়ের উদ্দেশেও বিয়ের পর বিচ্ছেদে যান।
জানা যায়, বিচ্ছেদের আবেদন করার তিন মাসের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঠেকানোর সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীর দুই পক্ষের কেউই সিটি করপোরেশনের সেই সালিশি বৈঠকে আসেন না। এরপর স্বংক্রিয়ভাবে বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৩ সালে ৭ হাজার ৫৯৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এর পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৬৯টি। চলতি বছর ডিসেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত মোট বিচ্ছেদ হয় ৮ হাজার ৪০৭টি। সব মিলে গত তিন বছরে ঢাকা উত্তরে মোট বিচ্ছেদ হয় ২৪ হাজার ১৭৫টি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৩ সালে ৭ হাজার ৫৩০টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এর মধ্যে স্বামী কর্তৃক বিচ্ছেদের আবেদন ছিল ২ হাজার ২৩২টি। আর স্ত্রীদের ছিল ৫ হাজার ২৯৮টি আবেদন। ২০২৪ সালে মোট বিবাহ বিচ্ছেদ হয় ৭ হাজার ৬৯৫টি। এর মধ্যে স্বামী কর্তৃক ১ হাজার ৯৯২টি আর স্ত্রী কর্তৃক ৫ হাজার ৭০৩টি বিচ্ছেদ আবেদন ছিল। ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট বিচ্ছেদের আবেদন পড়ে ৮ হাজার ১৭৪টি। এর মধ্যে স্বামী কর্তৃক বিচ্ছেদের আবেদন ছিল ২ হাজার ৩২৭টি আর স্ত্রী কর্তৃক বিচ্ছেদের আবেদন ছিল ৫ হাজার ৮৪৭টি। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (৮, ৯ ও ১০ অঞ্চল) আক্তার উননেছা শিউলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এখন আর আগের মতো নির্যাতিত হয়ে সংসার করতে চাচ্ছে না। আগে অত্যাচার সহ্য করে সংসার করলেও এখন আর তা হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি যে, বিয়ের মোটা অঙ্কের দেনমোহরের টাকা উসুল করার জন্য অনেক নারী তালাক নিয়ে নেন। বেশ কয়েকটি বিচ্ছেদের সালিশ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে দেখেছি যে, স্বামী অন্য নারীকে পছন্দ করেছে এখন আর সংসার করতে চান না। কিছু ক্ষেত্রে নারীদের স্বামী তার মায়ের কথা অনুযায়ী চলে এতে সংসারে অশান্তি থেকে তারা বিচ্ছেদে যান।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬ ও ৭ অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুজাউদ্দৌলা বলেন, যারা বিচ্ছেদের আবেদন করেন তারা শুনানিতে খুবই কম আসেন। সেখানে খুব কম সংখ্যক আবার সংসারে ফিরে যান। তা মোট সংখ্যার ১ শতাংশও না। দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাবুঝি না থাকা, পারিবারিক কলহ, প্রেম করে আগে বিয়ে করেছে কিন্তু এখন বনিবানা হচ্ছে না- এসব কারণে বিচ্ছেদ হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ ও ১০ অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে উদ্বেগজনকহারে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। তবে এই বিচ্ছেদ গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি। বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহনশীলতা বা ধৈর্য কমে যাচ্ছে। নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন। তাদের আর্থিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই পরিবারের শ্বশুর-শাশুড়ির নেতিবাচক ভূমিকাও এখানে কাজ করে। সংসার করার জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে যে প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন তা নেই। আর এ বিষয়ে পারিবারিকভাবে প্রশিক্ষণও নেই।
নারীর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এখন স্বাধীনভাবে থাকতে চায়। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাসক্তি, পরকীয়ার সম্পর্ক বিচ্ছেদে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খাইরুল চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও নারী শিক্ষার সম্পর্ক আছে। দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকায়। এ কারণে এখানে বিচ্ছেদের হারও বেশি। সাধারণত কম বয়সি দম্পতিদের মধ্যেই বিচ্ছেদ বেশি হয়। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনে ছেলে-মেয়েরা এখন পারিবারিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজেরাই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার হার বেড়েছে। এখন বিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যাশার জায়গায় পরিবর্তন ঘটেছে। আর এটি কাক্সিক্ষত না হলে বিচ্ছেদও দ্রুত ঘটছে।