Image description
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট-ফ্রন্ট গঠনের হিড়িক

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না’। প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের পর দেশি-বিদেশি চক্র নির্বাচন ঠেকানোর অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু নির্বাচনের ট্রেন থামেনি; বরং এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন তফসিল ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তার আগে আজ সিইসির ‘ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল’-এর ভাষণ রেকর্ড করার কথা। ১১ ডিসেম্বর সে ভাষণ প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হতে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই গোটা দেশে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে, ভোটের জোয়ারে ভাসছে মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মিটিং-মিছিল, শোডাউন, উঠোন বৈঠক চলছে।

এবারের নির্বাচন মূলত ২০১৪ সালের প্রার্থী ও ভোটারবিহীন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালের আমি ডামির মতো পাতানো নির্বাচন নয়। এমনকি ২০০৮ সালের সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও ভোটের আগেই ফলাফল চূড়ান্ত করে রাখার নির্বাচন নয়। এবার হচ্ছে সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের নির্বাচন। অতীতের তিনটি আসন ভাগাভাগির পাতানো নির্বাচনের সময় নদীর ঢেউ এক সাইটে প্রকম্পিত (আওয়ামী লীগ অনুসারীদের নির্বাচনী প্রচারণা) হলেও এবারের নির্বাচন নামের ঢেউ পুরো নদীর তোলপাড় ঢেউয়ের মতো সারাদেশে তোলপাড় চলছে। বিএনপি, জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দল আংশিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে; আবার জোট, মহাজোট, নির্বাচনী ফ্রন্ট গঠন করে বেশি সংখ্যক দলকে নিজেদের ছাতার নিচে এনে ভোটারদের বার্তা দেয়ার চেষ্টায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্তকরণ, প্রার্থী বাছাইয়ের মহাযজ্ঞের মধ্যেই সারাদেশে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত তিনশ’ আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন।

জেলা শহর, উপজেলা শহর, মফস্বল শহর ও গ্রামের হাটবাজারগুলোতে প্রার্থীরা ব্যাপক গণসংযোগ চালাচ্ছেন। ভোটাররাও নিজেদের মতো করেই কেউ পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন; কেউ রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং স্থানীয় প্রার্থীদের কার পক্ষে থাকবেন যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা করছেন। ঘরের গৃহিণীরাও বসে নেই। এবার নারীরাও সমান তালে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (ইটিআই) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ উপলক্ষে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, ‘দেশ বর্তমানে নির্বাচনের জোয়ারে ভাসছে। শতাব্দীর ভালো নির্বাচন চায় ইসি। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে’। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে গত ৩ ডিসেম্বর ইয়ারুল ইসলাম নামের একজন আইনজীবী আদালতে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট ওই রিট খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, ‘দেশের সব মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচন স্থগিত চেয়ে রিট দায়ের করার এখন উপযোগী সময় নয়। এ ধরনের রিট এই সময়ে গ্রহণযোগ্য নয়’।

ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দৃঢ়তায় নির্বাচন পেছানো এবং বানচালের দেশি-বিদেশি সব ধরনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। আগামী বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য তারিখের আগেই সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। ভোট ছাড়া মানুষের মুখে আর কোনো কথা নেই। একদিনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট, ফ্রন্ট গঠনের তোড়জোর চলছে; অন্যদিকে ভোটারদের নিজেদের পক্ষে নিতে প্রচারণা চলছে। অতীতের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা একই সুরে কথা বললেও এবার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন ভারতে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘সাংগঠনিক কার্যক্রম’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতসহ বাইরের শক্তিগুলো নানাভাবে ক্লিন ইমেজের আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেয়ার বায়না ধরলেও দলটি কার্যত ভোট করতে পারছে না। ফলে বিএনপির মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে জামায়াত। তাছাড়া একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াত এবারকার মতো রাজনৈতিক সুবিধা কখনো পায়নি। ফলে দলটির নেতারা অর্থ এবং দেশি-বিদেশি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাছাড়া ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের কিছুদিন পর থেকে আন্দোলনকালীন ঘনিষ্ঠতা বা সৌজন্য অনেকটাই পেছনে সরিয়ে রেখে বিএনপি ও জামায়াত একে অপরকে আক্রমণ করে কথা বলে আসছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং তাদের ছোট-বড় নেতাদের নির্বিচার পলায়ন এবং তাদের বিচারকার্য চলার কারণে রাজধানীসহ দেশজুড়ে মাঠ ফাঁকা পেয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রশাসনযন্ত্র দখলের অভিযোগ ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জামায়াত গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া এনসিপি নেতাদের সহায়তায় প্রশাসনে নিজেদের অনুগত আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। এখন আমলাদের ব্যবহার করে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ফন্দিফিকির করছে। মূলত দলটি সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর চক্রান্তে শামিল হয়েছিল। সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ‘আগে গণভোট’ পরে ‘জাতীয় নির্বাচন’ দাবিতে জামায়াত আন্দোলন করলেও প্রায় ৬ মাস আগে দলটি তিনশ’ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই দলটি নিজেদের দাবির আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়নি। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি গত মাসে প্রথম দফায় ২৩৭ আসন, পরবর্তীতে ৩৬ আসন মোট ২৭২ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। বাকি আসনগুলো দলীয় নেতা ও শরিক দলগুলোর নেতাদের ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে যে ছোট ছোট দল বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবে পরবর্তীতে যুগপৎ আন্দোলন করেছে সে দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে প্রার্থী করার গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে। আবার বিভিন্ন আসনে দলীয় প্রার্থী বদল করার দাবিতে প্রতিবাদ-আন্দোলন হচ্ছে। তারপরও বিএনপি থেকে যারা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন তারা পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। পোস্টারে পোস্টারে ভাসিয়ে দিয়েছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা। অন্যদিকে জামায়াত ৬ মাস আগে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং দলটির প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক পোস্টারিং করেছে। এখন ৮ দলীয় জোট গঠন হওয়ায় নতুন করে শরিকদের মধ্যে আসন বিন্যাস করার ঘোষণা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিএনপির বিরুদ্ধে ইসলামী ধারার দলগুলো নিয়ে বৃহৎ জোট গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জামায়াত ৮ দলীয় জোট গঠন করেছে। জামায়াত ছাড়াও ওই জোটে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি। গতকাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আসন সমঝোতার ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্যের ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। সমঝোতার মাধ্যমে একটি আসনে ৮ দলের একজন প্রার্থী থাকবে’।

নির্বাচনের নানান হিসাব-নিকাষ কষে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রত্যাশিত আসন বিএনপির কাছে না পাওয়ায় তিনটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ নামে রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে। এনসিপি ছাড়া অন্য দল দু’টি হচ্ছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এছাড়াও দেশের রাজনীতিতে পরিত্যক্ত জাতীয় পার্টির (জাপা) দলছুট কিছু নেতা এবং হাসিনার অলিগার্ক জাতীয় পার্টির (জেপি) নেতারা আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ১৮টি দলের সমন্বয়ে ‘১৮ দলীয় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ’ গঠন করেছে। এ জোটে শরিক দলগুলো হচ্ছে দলছুট জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টির (জেপি), জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় ইসলামিক মহাজোট, জাতীয় সংস্কার জোট, স্বাধীন পার্টি, জাতীয় স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি, অ্যাপ্লায়েড ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। এরা ছাড়াও বাম ধারার দলগুলো নির্বাচনী জোট গঠন করেছে নিজেদের মতো করে।

ইনকিলাবের আঞ্চলিক অফিস, জেলা, উপজেলা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত সাংবাদকর্মীরা জানান, জেলা শহর, পৌরশহর, উপজেলা, গ্রামীণ হাটবাজারগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণা মুখ্য হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে কোন দলের কে প্রার্থী হচ্ছেন, প্রার্থী মনোনয়ন ভালো হলো না খারাপ হলো ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণে চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর আমজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী ও সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে, অন্যের কাছে নিজের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রতিটি আসনে বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপির নেতা-কার্মীদের সঙ্গে জামায়াতের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাগি¦ত-া হচ্ছে; পাল্টাপাল্টি প্রচারণা চলছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও তিক্ততা চলছে ।

গতকালও সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেনে উঠে গেছি আমরা।’