২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারীদের মোবাইলে দফায় দফায় সিঙ্গাপুর ও ভারত থেকে ফোনকল আসে। বিদ্রোহের পর কয়েক দফা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধও করা হয়। তৎকালীন প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক তখন ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারে (এনএমসি) নজর রাখছিলেন। এনএমসিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ফোনকল মনিটরিংয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে বিডিআরের তৎকালীন ডিজির মৃত্যুর সংবাদ পান। বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ১৬ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ৩০ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক ও বিদেশি যোগাযোগের ফোনকল রেকর্ড মুছে ফেলার তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। সেনা তদন্ত আদালত এবং জাতীয় তদন্ত কমিটি মোবাইল কল রেকর্ড/সিডিআর সংগ্রহ করেনি এবং এ বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা থেকে বিরত থেকেছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বিদ্রোহের পর বিদ্রোহীদের মধ্যে সিগন্যাল কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা এবং ভেতরে এক ধরনের কমান্ড সেন্টার ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া মোবাইল কল ট্র্যাক করে অফিসারদের খুঁজে খুঁজে বের করা হয়েছিল মর্মে সাক্ষ্য পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে বিদেশি ফোন নম্বর থেকে যেসব ফোনকল এসেছিল তাদের পরিচয় তদন্তকালে বের করতে পারেনি কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআর বিদ্রোহের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর তখনকার মোবাইল ফোনের একটি কল রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকালের দিকে সিঙ্গাপুর থেকে একাধিকবার ফোন আসে। তোরাব আলী কলদাতার সঙ্গে প্রায় ৫ মিনিট কথা বলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটের মধ্যে তোরাব আলীর কাছে ভারতীয় একটি নম্বর থেকে একাধিকবার কল আসে। কলদাতার সঙ্গে তোরাব আলী চার মিনিটের বেশি সময় কথা বলেন। আবার ২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টার দিকে তোরাব আলীর কাছে সিঙ্গাপুরের একই নম্বর থেকে কল আসে এবং সেখানে তিনি ১ মিনিটের বেশি সময় কথা বলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি একই নম্বর থেকে দুপুর ১টায় সিঙ্গাপুর থেকে আবার তার কাছে কল আসে এবং তিনি ৪৩ সেকেন্ড কথা বলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তোরাব আলীর কাছে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৬ মার্চ ২০০৯-এর মধ্যে ২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্যতীত সিঙ্গাপুর বা ভারত থেকে আর কোনো কল আসেনি বা তিনিও সিঙ্গাপুর বা ভারতের কোথাও কল করেননি। তোরাব আলী জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পূর্বের কোনো কমিটি তাদের প্রতিবেদনে কারা তোরাব আলীকে ভারত এবং সিঙ্গাপুর থেকে কল করেছিল, কি কথা হয়েছিল তা উদ্ঘাটন করেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখ ডিজিএফআইয়ে স্থাপিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারের (এনএমসি) প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোরশেদ আলম মোবাইল নেটওয়ার্ক মনিটর করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে বা সন্ধ্যায় লে. কর্নেল সুলতানুজ্জামান সালেহ (পরে মেজর জেনারেল) মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিকের নির্দেশে মনিটরিং সেলের ভেতরে প্রবেশ করে দীর্ঘক্ষণ মনিটরিংয়ের কাজ করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি মোবাইল নেটওয়ার্ক মনিটরিংয়ের সময় সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ব্রি. জেনারেল খোরশেদ আলম ডিজির (মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ) মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলেন এবং সেই সংবাদ ডিজি যথাসময়ে ডিজিএফআইকে জানিয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সিটিসেলের টেকনিক্যাল হেড তানভীর রানা সেই সময় নেটওয়ার্ক বন্ধ করা ও ডাটা মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। অন্য কেউ তাকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেশে না থাকায় তানভীর রানাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি। আর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটা বা এগারোটার মধ্যে নির্দিষ্ট একটি মোবাইল নম্বর তখনও অ্যাক্টিভ ছিল। ধারণা করা হয়, কোনো অফিসার সুয়ারেজ/নর্দমা থেকে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে শনাক্ত করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্তভাবে মোবাইল মনিটরিং করা হয়েছে এবং কোনো কোনো সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিক্ষিপ্তভাবে বন্ধ করা সংক্রান্ত কোনো তথ্য বিটিআরসি প্রদান করতে পারেনি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনী, এএফডি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ সদর দপ্তর এবং র্যাবের কাছ থেকে উক্ত সংস্থাগুলোতে কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টেলিফোন নম্বর অত্র কমিশন কর্তৃক চাওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরও চাওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মোবাইল ফোন নম্বর প্রদান করতে পারেনি।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিটি চিঠি দিয়ে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কাছে কল রেকর্ড চেয়েছিল। কিন্তু সেনা সদর, ডিজিএফআই এবং বিটিআরসি কেউই তা দেয়নি। সবাই বলেছিল প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। সেকেন্ডারি সোর্স থেকে পাওয়া কল রেকর্ডে শুধু বিডিআরের র?্যাব সদস্যদের নম্বর ছিল। রাজনৈতিক বা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো নম্বর ছিল না। বিডিআর বিদ্রোহে তৎকালীন সময়ে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জুনিয়র অফিসারগণ কর্তৃক উদ্ধারকৃত এবং ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষিত সিডিআর থেকে কমিশন দেখেছেÑ ভারত থেকে মোবাইলে কিছু কিছু ফোন নম্বরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছে। তৎকালীন লে. কর্নেল শামসের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে দুবার পিলখানার বাইরে নিউমার্কেট এলাকায় স্থান পরিবর্তন করে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সাহারা খাতুন, ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, এটিএন বাংলার সাংবাদিক এসএম বাবু এবং অন্যদের সঙ্গে ঘটনার সময় এবং ঘটনার পূর্বে কথা হয়েছে মর্মে স্বীকারোক্তি এবং সাক্ষীদের জবানবন্দি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের (জাহাঙ্গীর কবির নানক) ও বিদ্রোহীদের (ডিএডি তৌহিদ) সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে এবং সাবেক ডিজি বিডিআর ও বিডিআরে কর্মরত অফিসারগণ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রায় সকল পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে মর্মে সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।