Image description

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন থেকে নিজেই বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে নাটকীয় মোড় নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ছিটকে পড়ছে নয়াদিল্লির নজর থেকে। নিজের অন্যান্য স্বার্থে ভারত এখন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নিচ্ছে।

এ লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপও নিয়েছে ভারত। এখানে দূতিয়ালি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের একটি দেশ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন কাম্য নয়, ভূ-রাজনৈতিক কারণে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই। নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এমন বার্তা নিয়ে খুব শিগগিরই ঢাকায় আসছেন।

উপরের কথাগুলো লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। কোন সূত্র থেকে জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক তথ্যগুলো পেয়েছেন, তা উল্লেখ করেননি। তিনি দাবি করেন, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। সত্যিই কী আওয়ামী লীগের বিষয়ে ভারতের মনোভাবে পরিবর্তন আসছে? আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাচ্ছে?

মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকও করেন অজিত দোভাল। খলিল-দোভাল বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক  বক্তব্যে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।

গত ৭ই ডিসেম্বর 'মোদি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবেন: বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে নাটকীয় মোড়' শিরোনামে প্রকাশিত এক মন্তব্য কলামে মতিউর রহমান চৌধুরী এসব কথা বলেন। তার বক্তব্য ও দাবির বাস্তবতা কতটুকু, তা অনুসন্ধান করেছে সুখবর ডটকম।

অনুসন্ধান বলছে, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট থেকে ভারতে অবস্থান নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন এসেছে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি। তার কোন বক্তব্যের আলোকে মতিউর রহমান চৌধুরীর পত্রিকা মানবজমিন ওই ধারণা করছে, তা জানা-বোঝার কোনো উপায় নেই। এটা তাই বায়বীয় দাবির মতো।

বিশেষ এক পরিস্থিতিতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানেই থাকবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত একান্তই তার ওপর নির্ভর করছে, শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে সবশেষ মন্তব্যে এমনই বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। যা ইঙ্গিত দেয়, ড. ইউনূসের সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠাতে অনুরোধ জানালেও ভারত এতে সায় দিচ্ছে না।

জয়শঙ্কর আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন। এতে প্রমাণ হচ্ছে, ভারত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এর মানে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ভারত।

মতিউর রহমান চৌধুরী দাবি করেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে দু’দেশের (বাংলাদেশ-ভারত) সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এমন বার্তা নিয়ে খুব শিগগিরই ঢাকায় আসছেন।

তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে অনুমোদন পেয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসছেন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন। ঢাকায় এলে প্রতিরক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকির বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেননি। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ভালো নয়। ভারত কী ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনকে দূতিয়ালির সুযোগ দেবে?

মতিউর রহমান চৌধুরী লেখেন, 'জুন (চলতি বছরের) থেকে নাটকীয় পরিবর্তনের দিকে পরিস্থিতি গড়াতে শুরু করলো। ইউরোপীয় একটি দেশের দূতিয়ালিতে ভিন্ন এক পরিস্থিতি। দরজা খুললো আলোচনার। সীমিত পর্যায়ের যোগাযোগ। তবে সংশয় আর সন্দেহ মাঝখানে দেয়াল হয়ে রইলো। কোথায় যেন গোলমাল। তৃতীয় দেশটি আলোচনার তাগিদ দিলো। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে অনেকখানি। তারা জানিয়ে দিলো, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন কাম্য নয়।' ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন দেশটি কথিত দূতিয়ালি করছে, তা তিনি উল্লেখ করেননি।

তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই। নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এমন বার্তা নিয়ে খুব শিগগিরই ঢাকায় আসছেন। এই পটভূমিতেই ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রাথমিক আলোচনার পর দিল্লিতে ড. খলিলকে আমন্ত্রণ জানান অজিত দোভাল।

ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা বিবিসি বাংলাকে সম্প্রতি বলেন, ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বা প্রকাশ্যে যেগুলো বলা সম্ভব নয়, তার অনেক কথাই দেশটিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে। দিল্লির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও  জেএনইউ-র সাবেক অধ্যাপক ড. বলদাস ঘোষাল বলেন, শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্য দিয়ে ভারতই একটু আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে। আসলে বাংলাদেশে সম্প্রতি এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেটাকে দিল্লি পরিষ্কার ভারত-বিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করছে।

তিনি বলেন, যেমন, সে দেশে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল বা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর–কিংবা ধরা যাক সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য। দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংক মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে।

ড. পট্টনায়কের ধারণা, এই যে ভারত এখন শেখ হাসিনাকে আরও বেশি করে মুখ খুলতে দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার পর্যন্ত দিতে দিচ্ছে, তার মূলে আছে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা।

এদিকে গত বছরের ৫ই আগস্টের নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর সেই ঘটনাপ্রবাহ বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে একটা বাঁকবদলের অবকাশ তৈরি করে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেছিলেন, দেশের পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির ভালো ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় খালেদা জিয়ার দলই ভারতের জন্য ওই মুহূর্তে সেরা 'বাজি' হয়ে ওঠে।

অনেকে ধারণা করেন, অতীতের তিক্ততা দু'পক্ষই ভুলে গিয়ে ভারত ও বিএনপির মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিকে যাত্রা শুরু হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে এতে বিএনপির দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া মিললেও শেষ পর্যন্ত দলটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সেভাবে গড়ে উঠেনি। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও দলটির ইতিহাসে 'দুঃসহতম পরিস্থিতিতে'ও ভারতের সঙ্গে বিএনপি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে এখনো ভারত আগের অবস্থানেই রয়েছে।

সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত প্রায় ১৬ মাসের বিভিন্ন সময়ে ভারতের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত সংগঠনের কর্তারা ভারতীয়সহ পশ্চিমা প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে বিএনপি ও ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি ভারতের অবস্থানের মনোভাব বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সরাসরি উপস্থিতি না থাকলেও বিএনপির প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দেশটি অনাগ্রহী।

ভারতের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত সংগঠনগুলোর মধ্যে যেগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মন্তব্য-বক্তব্য সুখবর ডটকম পর্যালোচনা করেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন (আরজিএফ), অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ), বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (ভিআইএফ) ও ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ (আইডিএসএ)।