ঢাকার অদূরে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষক মো. লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন নিজ বিভাগের একাধিক নারী শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ, ক্লাসে বিভিন্ন অশালীন কথা বলা ও ফেসবুকে আপত্তিকর বার্তা পাঠাতেন বিভাগের প্রভাষক লিমন। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কাছে পৃথক লিখিত অভিযোগও করেছেন ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, নয় মাস আগের ঘটনায় গত ২ ডিসেম্বর করা মামলায় পিকনিকের কথা বলে আশুলিয়ায় নিয়ে গিয়ে একই বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ‘ধর্ষণ’ ও ভিডিও ধারণের মামলার পর আন্দোলনে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে বিভাগের প্রভাষক লিমনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আসার পর দুটি ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকায় তিনিসহ বিভাগের আরেকজন শিক্ষককে ছুটিতে পাঠিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করেছে প্রশাসন।
লিমনকে ১৬ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে কুখ্যাত অপরাধী বিবেচনা করে বাম পায়ে গুলি করে র্যাব—৮ এর কয়েকজন সদস্য। পরে লিমনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেদিনই তার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করে র্যাব। এর ৪ দিন পর লিমনের বাম পা কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পা দিয়ে চলাফেরা করছেন।
সেই সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার শিকার তরুণ লিমন পিজিএস কাউখালী কারিগরি বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৭ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে অনার্স এবং ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানে লিমনের একাডেমিক যোগ্যতা কম ছিল। তবে তিনি ‘মানবিক’ বিবেচনায় সেই সময় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের পরোক্ষ শক্তিতে নানা অনিয়ম করতে থাকেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর নিজ বিভাগে ধর্ষণে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের পক্ষে থানায় গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি।
ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, প্রভাষক লিমন হোসেন বিভিন্নভাবে তাদের যৌন হয়রানি করছেন। তিনি তার কেবিনে নারী শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে বিভিন্ন অশালীন মন্তব্য করতেন। অনেক সময় তাদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অশালীন বার্তা পাঠাতেন। যেমন, তার স্ত্রী তাকে সুখী করতে পারে না, সে যৌনতার ক্ষেত্রে অনেক একাকীত্বতায় ভোগেন, এছাড়াও অনেক আপত্তিকর কথা, যা প্রকাশ করার মতো নয়।
এছাড়াও অপর একটি লিখিত অভিযোগ করা হয় আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। পাঁচটি দফা উল্লেখ করা ওই অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষক লিমন হোসেন ধর্ষণে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সশরীরে থানায় গিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টাও অপরাধের শামিল।
এছাড়া ক্লাসে পড়ানোর ছলে তিনি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনে জোরপূর্বক প্রবেশ করে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত বিষয় সকলের সামনে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীদের হেয় করেন।
একজন শিক্ষক হিসেবে তার পড়ানোর পদ্ধতি কোনো ভাবেই গবেষণা কেন্দ্রিক নয় উল্টা তিনি গলাদ্ধকরণ পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেন। যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধাকে বিনষ্ট করেন।
তিনি স্বজনপ্রীতি নীতি ব্যবহার করে, ব্রিটিশ পদ্ধতি Divide and Rule policy প্রয়োগ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেন যা পরবর্তীতে বড় অপরাধের জন্ম দেয়।
ক্যাম্পাসে বিগত দিনে ঘটে যাওয়া প্রায় সকল অপরাধের সাথে জড়িত চক্রের সাথে এমনকি সম্প্রতি বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের সাথেও প্রভাষক লিমন হোসেনের একান্ত সম্পর্কে বিদ্যমান এবং তাদের প্রকাশ্য মদদদাতা তিনিই যা শিক্ষার্থী মনে ক্রমশ ভীতি সঞ্চারণ করে যাচ্ছে।
এর আগে রবিবার (৭ ডিসেম্বর) ক্যাম্পাসের একটি মিলনায়তনে শিক্ষার্থীরা প্রভাষক লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরে বক্তব্য দেন। সেখানে তারা দ্রুত লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান।
একাধিক শিক্ষার্থী জানান, উনি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহী। যা আমাদের বিব্রত করে। এমনকি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-বিচ্ছেদের গল্পও বারবার বলে বিব্রত করতে থাকেন। কে কার সাথে মিশবে না মিশবে সে ব্যাপারেও তিনি বারবার হস্তক্ষেপ করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক লিমন হোসেন বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত নই। আমি এ ধরনের কোনো কথা বলি নাই। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
তিনি আরও বলেন, আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে।
যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান ড. ওয়াহিদা জামান লস্কর বলেন, যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের সভাপতির দায়িত্বের বিষয়ে প্রশাসন থেকে চিঠি প্রদান করা হয়েছে। তবে উপাচার্যের কাছে প্রদানকৃত অভিযোগ পত্রের বিষয়ে তিনি এখনো অবগত নন।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে সাত দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলাকালে আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রফিকুল আলম ও প্রভাষক লিমন হোসেনকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এই সময়ে তারা একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন।
তদন্ত কমিটিতে ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জহিরুল ইসলাম খানকে সভাপতি ও বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু রায়হানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
জানা যায়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে পা হারায় লিমন। ওই সময় সে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। রাজাপুর উপজেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী দুই সহোদর মিজান ও মোর্শেদকে ধরতে গিয়ে সোর্সের ভুল তথ্যের কারণে ১৬ বছরের কিশোর লিমনের পায়ে গুলি করে র্যাব। পরে চিকিৎসকরা তার একটি পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ রাতেই লিমনসহ ৯ জনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা দায়ের করেন র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান। একটি অস্ত্র আইনে এবং অপরটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে। দুটি মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন লিমন। ২৪ মার্চ লিমনকে রাজাপুর হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। ২৫ মার্চ লিমনকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে ২৭ মার্চ চিকিৎসকরা লিমনের বাম পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলেন।