দেশে গত ১৫ দিনে অনুভূত হয়েছে ৯ বার ভূমিকম্প। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.৭ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয় গত ২১ নভেম্বর। প্রাণহানি ঘটে ১০ জনের। যাদের তিনজনই পুরান ঢাকার বাসিন্দা। সারা দেশে আহত হন হাজারের বেশি মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ১৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে সবশেষ ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। ৪.১ মাত্রার এই ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর শিবপুরে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানীর পুরান ঢাকা। সেখানের ঘরবাড়িগুলোর বড় অংশই জরাজীর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা থাকলেও ভূমিকম্প নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সচেতনতা নেই। গত ২৮ নভেম্বর পুরান ঢাকার শ্যামপুর, সদরঘাট ও চকবাজার এলাকায় সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে এ চিত্র উঠে আসে।
গতকালের ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অনুভূত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটিই ছিল মূল ভূমিকম্প। পরবর্তীতে যেগুলো হচ্ছেÑ সেগুলো মূলত ওই ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া বা আফটারশক।’
তিনি বলেন, ‘৫.৭ মাত্রার মূল ভূমিকম্পটি স্বাধীনভাবে সংঘটিত হয়েছে অর্থাৎ এটি কোনো পূর্ববর্তী কম্পনের ওপর নির্ভরশীল নয়। ভূগর্ভে যে শক্তি সঞ্চিত ছিল তা ফল্ট বরাবর মুভমেন্টে এই শক্তিটা ভূমিকম্পের মাধ্যমে রিলিজ হয়েছে।’
পুরান ঢাকা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ
পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় রূপলাল হাউসটি নির্মিত হয় ১৮৪৫ সালে, বর্তমানে এটি জরাজীর্ণ। সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটি পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও পানের আড়ত হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভবনটি অনেক পুরাতন জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তারপরও উপায় নেই। কারণ ব্যবসা করার জন্য উপযুক্ত নতুন ভবনের অভাব রয়েছে এখানে।’ ১৮২৫ সালে একই এলাকায় নির্মিত ও বর্তমানে জরাজীর্ণ শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ ও লক্ষ্মীণারায়ণ জিউ মন্দিরের নিচে দেওয়া হয়েছে মসলা ও খাবারের দোকান। তাদেরই এক মসলা ব্যবসায়ী বললেন, ‘পুরাতন ঢাকা ঘিঞ্জি এলাকা। এখানে অল্প জায়গায় অনেক দোকান। বেশিরভাগ বিল্ডিংই পুরনো ও ভাঙা। তারপরও কিছু করার নেই। আমরা যাব কোথায়?’
দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে চকবাজারে ব্যবসা পরিচালনাকারী মো. ইব্রাহিম খলিলের কাছে ভূমিকম্পে সচেতনতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২১ নভেম্বর সকালের ভূমিকম্পে আমরাও কেঁপে উঠেছি। কিন্তু স্থানীয়দের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা নেই। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে, কোথায় দাঁড়াতে হবে এসব নিয়ে তেমন আগ্রহও দেখি না।’
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশভবন, সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টি, ভাষা শহীদ রফিক ভবন এবং প্রশাসনিক ভবনসহ ৪টি ভবন রয়েছে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। ২০২৩ সালে রাজউক জবির চারটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেগুলো দ্রুত খালি করার নির্দেশ দিলেও গত দুই বছরে এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। ভবনগুলোর দেয়ালে ফাটল, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়া, অবকাশ-সোশ্যাল সায়েন্স ও রফিক ভবনে ছাদ থেকে পানি চুয়ে পড়া, ভবনগুলোর নানা স্থানে স্পষ্ট ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমাদের ৮ ভবনের ৪টিই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ২০২৩ সালে ভূমিকম্প ও অগ্নিনিরাপত্তা-বিষয়ক একটি মহড়া হয়েছিল। তারপর আর এমন কর্মসূচি নেওয়া হয়নি।’ এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজউক জবির ৪টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। এটা হাস্যকর এবং রাজউকের তামাশা।’ রাজউক কোন বিবেচনায় ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘তবে এগুলো যে একেবারে পারফেক্ট সে কথাও বলছি না।’
৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরান ঢাকা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে উল্লেখ করে ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘এ অঞ্চলের রাস্তাঘাটগুলো খুবই সংকীর্ণ। তাই রাজউক ও সিটি করপোরেশনের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে এ ধরনের রাস্তা করতে হবে।’ সকল পর্যায়ের মানুষকে ভূমিকম্প থেকে জীবন রক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৯ লাখ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, শুধু ঢাকাতে ৬ লাখ
দেশের কোনো অঞ্চলের ভবনগুলো ভূমিকম্পে কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তা নিয়ে ২০০৯ সালে ‘আর্থকোয়েক রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অব ঢাকা, চিটাগং অ্যান্ড সিলেট সিটি করপোরেশন এরিয়া’ শীর্ষক গবেষণা করেছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তাতে তিন বিভাগে ৯ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কথা বলা হয়। যার মাঝে ঢাকায় ৫ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ৪১ হাজার এবং সিলেটে ১ লাখ। ২০১৮ সালে এ তথ্য হালনাগাদ করে জানানো হয় শুধু ঢাকাতেই ৬ লাখ ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে।
রাজউকের ২০১৮ সালের এক জরিপের মূল্যায়নে বলা হয়, ঢাকায় ৫-৩০ তলাবিশিষ্ট ৬ লাখ ভবন উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ভবনের ভিত্তি দুর্বল ও নকশা যথাযথভাবে মানা হয়নি। অপরদিকে রাজউকে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের আওতায় ২০১৮-২২ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় করা এক জরিপের তথ্যে বলা হয়, ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ২০০৯ সালে হওয়া গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের সাবেক ডিন ও ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলেন্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘গবেষণাটি বেশ আগের হলেও এর আবেদন রয়েছে। এখন জরিপ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত অপসারণ করে নতুন ভবন বানাতে হবে। আর কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কার করা দরকার।’
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
আহ্ছান উল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেক্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদা নিলুফার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্ট্রাকচারাল (কলাম, বিম, দেয়াল) কারণে যেসব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; সেগুলো রাখার কোনো সুযোগ নেই। আর বিল্ডিং কোড (কতটুকু বালি, সিমেন্ট, রড, ইট ব্যবহার ও ভবনের চারপাশে ফাঁকা জায়গা রাখা) নির্ধারণের আগে যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, তা মূলত স্থানীয় মিস্ত্রিদের চিন্তাচেতনা থেকেই নির্মাণ হয়েছে। এসবের অনেক ভবন দুর্বল।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘পুরান ঢাকার মানুষের হাতে বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। সেখানে রয়েছে ভাড়াটিয়া ও ব্যবসায়ী দুটি গ্রুপ। মালিকরা দোকান, গোডাউন ও বাড়ি ভাড়া দিয়ে অন্য জায়গায় বসবাস করে। সরকার যদি শক্তি প্রয়োগ করত তাহলে পুরান ঢাকার এ অবস্থা থাকত না। মানুষের চাওয়া না চাওয়ার চেয়ে রাষ্ট্রের কাজ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া, সচেতনতা বৃদ্ধি করা।’ এক্ষেত্রে নগর ব্যবস্থাপনা, বিল্ডিং কোড ও সিটি করপোরেশনের কাজগুলো যথাযথভাবে করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
