দেশের ইতিহাসে রেকর্ডকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের নজির স্থাপন করেছে বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (এমএসটিপিপি)। গত নভেম্বরে বাংলাদেশের যে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে সর্বোচ্চ মাসিক উৎপাদন করেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। আর এটি সম্ভব হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন কয়লা সরবরাহের কারণে। বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লি. (বিএমটিএল)-এট্রো-ইএনআর কনসোর্টিয়াম কর্তৃপক্ষ এ
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নভেম্বরে ৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করে। যা এ পর্যন্ত দেশের কোনো জেটিতে সর্বাধিক পরিমাণ কয়লা খালাস করার রেকর্ড। এর আগে ডলার সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এলসি খুলতে না পারার মতো জটিলতার সম্মুখীন হয়। কিন্তু কয়লা সরবরাহের পাশাপাশি এবার বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থ বিনিয়োগও শুরু করছে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ সময়মতো এলসি খুলে পর্যাপ্ত কয়লা মজুত করতে পারছেন, যা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আগে ধারণা ছিল যে, এখানে বিভিন্ন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি রয়েছে, যার কারণে কেন্দ্রটি প্রত্যাশামতো উৎপাদন করতে পারছে না। কিন্তু সাম্প্রতিক রেকর্ড উৎপাদন প্রমাণ করেছে যে, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো বড় ধরনের প্রযুক্তিগত সমস্যা নেই। যথাযথভাবে কয়লা সরবরাহ পেলে কেন্দ্রটি পুরো সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক সংবাদ।
কয়লা সরবরাহের বিষয়ে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্নভাবে কয়লা সরবরাহ করছেন। যার কারণে নভেম্বর মাসে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেছে। একই সঙ্গে মজুত সক্ষমতাও ২ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে।
নিয়মিত কয়লা সরবরাহ থাকায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কয়লা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ডকইয়ার্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ২ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লার মজুত ছিল। এর আগে কম পরিমাণ কয়লা আসত এবং তা দিনেরটা দিনেই শেষ হয়ে যেত।
এমএসটিপিপির সঙ্গে তিন বছরে ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহে ২০২৩ সালে জুলাই মাসে বিএমটিএলের চুক্তি হয়। এরই মধ্যে বিএমটিএল ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে সরবরাহ করেছে।
ডলার সংকটের কারণে এমএসটিপিপি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত এলসি খুলতে পারতেন না। যে কারণে বিএমটিএল কর্তৃপক্ষকেও সময়মতো বকেয়া দিতে পারত না রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আগের চেয়ে এখন বকেয়া পরিশোধে গতি কিছুটা বেড়েছে। এর আগে এলসি খুলতে না পারার কারণে বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ কাক্সিক্ষত কয়লা আমদানি করতে পারেনি। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এবং পর্যাপ্ত কয়লা আমদানির জন্য বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ এমএসটিপিপি কর্তৃপক্ষকে বিনা সুদে অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
এতে করে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা আমদানির জন্য সময়মতো এলসি খুলতে পারছে। আগে যেখানে কয়লার সংকট ও অর্থের অভাবে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো না কিন্তু বিএমটিএল এর অর্থায়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সময়মতো এলসি খুলতে পারছে এবং রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনও করতে পারছে।
এর আগে গত অক্টোবরে ৪ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করে বিএমটিএল। গত নভেম্বরে সেখানে ৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করা হয়। যা এ পর্যন্ত দেশের কোনো জেটিতে সর্বাধিক পরিমাণ কয়লা খালাস করার রেকর্ড। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বর মাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৭০০ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার রেকর্ড করেছে। যা বাংলাদেশের যে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে সর্বোচ্চ মাসিক উৎপাদন। এটি দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে ৬০০ মিলিয়ন ইউনিটেরও বেশি বা বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশ সরবরাহ করে আসছে।
সূত্র জানায়, সাধারণত ৪ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানির জন্য এলসি খুলতে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। তিন মাস ধরে বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে এ অর্থায়ন করছে। আর এলসি সময়মতো খুলে রেকর্ডসংখ্যক কয়লা আমদানি করার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে।
ড. ইজাজ হোসেন আরও বলেন, ‘কয়লার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার জোগান নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য এবং আমি এ পদ্ধতিকে সমর্থন করি। তবে নিশ্চিত হতে হবে কয়লার যে দাম নেওয়া হচ্ছে, তা চুক্তি অনুযায়ী সঠিক কি না। যদি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হয়, তাহলে বিদ্যুতের সামগ্রিক মূল্য কাঠামোর ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। যদি দেখা যায় চুক্তির বাইরে কোনো অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে না এবং বিদ্যুতের দামেও কোনো প্রভাব পড়ছে না, তবে এভাবে কয়লার সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক।’
সাফওয়ান বসুন্ধরা গ্লোবালের শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক ম্যানেজার আফজাল ইবনে জাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেহেতু দেশে জ্বালানিসংকট চলছে আর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে দেশের অন্যতম বড় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এজন্য এখানে আমরা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গত দুই বছরে আমাদের নিয়মিতভাবেই ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের পাওনা বকেয়া ছিল। এরপরও কোনো প্রকার সুদ ছাড়াই নিয়মিত কয়লা সরবরাহ করে গিয়েছি।
এ পর্যন্ত বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ কয়লা খালাস বাবদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাছে পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ। এর বাইরে বিএমটিএলের আরও ছয়টি কয়লাবাহী জাহাজ পথে আছে। যার মূল্য ৪২ মিলিয়র ডলার।
এরই মধ্যে অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বকেয়ার কারণে একবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। একই কারণে বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে। অপরদিকে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও কয়লার অভাবে বেশ কয়েকবার বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনটিপিসি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বাস্তবায়ন করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২৪ সালের মার্চে। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট থেকে পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।