মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত ছিল ১০৩ জনের সিন্ডিকেট। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী-এমপিও রয়েছেন। সবাই চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ নেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে। উল্টো আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাদের দায়মুক্তি দেয়ার আবেদন জানিয়েছে সংস্থাটি। এ-জাতীয় অপরাধ তদন্তে বিশেষায়িত ইউনিট থাকার পরও অভিযোগের স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ
না পাওয়ায় এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও।
সিআইডির দেয়া এ প্রতিবেদনকে পক্ষপাতমূলক বলে উল্লেখ করেছেন আদালত। সিন্ডিকেটের সদস্যদের প্রতি এমন নমনীয়তার পেছনে তদন্তসংশ্লিষ্টদের অনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয় থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানব পাচার, চাঁদাবাজি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ এনে ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় মামলা করেন জনশক্তি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান আফিয়া ওভারসিজের মালিক আলতাফ খান। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ দল (টিএইচবি)। এটিই দেশের একমাত্র মানব পাচারসংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের বিশেষায়িত ইউনিট। দীর্ঘ তদন্তের পর তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করলেও সব আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দায়মুক্তির আবেদন করে সংস্থাটি।
এ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সিআইডির পাঁচ কর্মকর্তা। মামলাটি তদন্ত করেন সিআইডির হিনিয়াস ক্রাইমের পরিদর্শক মো. রাসেল। তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ সিন্ডিকেটের ১০৩ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমন প্রতিবেদনকে পক্ষপাতমূলক উল্লেখ করে আদালত মামলাটি তদন্তের ভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে ন্যস্ত করেন।
মামলার বাদী আলতাফ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আসামিদের প্রভাবে সিআইডি মনগড়া ও পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। আদালত সেই রিপোর্ট বাতিল করে সুবিচারের পথ খুলে দিয়েছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলাটির তদন্ত করেন সিআইডির হিনিয়াস ক্রাইমের পরিদর্শক মো. রাসেল। তদন্তের তদারক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও বিশেষ পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোল্লা। তদন্ত শেষে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিকে সমর্থন দিয়ে তা অগ্রগামী করেন অতিরিক্ত ডিআইজি একরামুল হাবিব ও অতিরিক্ত ডিআইজি আলি আকবর খান (ডিআইজি দায়িত্বে)। চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি সর্বশেষ অনুমোদন দেন সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে সিআইডি এসব আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় মামলা করে। গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, ২০২২-২৪ সালের মধ্যে অভিযুক্তরা যোগসাজশে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে প্রায় ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন।
চিহ্নিত মানব পাচারকারীদের অপরাধ প্রমাণ করতে না পারার কারণ জানতে যোগাযোগ করা হয় তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির হিনিয়াস ক্রাইমের পরিদর্শক মো. রাসেলের সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ মামলায় মানব পাচার, চাঁদাবাজি ও অর্থ পাচারের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ বাদী সরবরাহ করতে পারেননি। ফলে মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়েছে। এখানে আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়ার সুযোগ নেই।’
লেনদেনের ভিত্তিতে তদন্তকারীরা মানব পাচারকারীদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যারা ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিদেশে পাঠানোর নামে মানব পাচারের মতো অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে, তারা খুবই শক্তিশালী। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তারা এমন কাজ করে। সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করেই তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ ধরনের কাজের ফলে দেশের সুনাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষুণ্ন হয়। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের দেশে একটি বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে। আমরা দেখেছি এসব ইউনিট বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা তাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকেন। আবার রাজনৈতিক সরকার না থাকলেও মানব পাচারের এ চক্রের প্রভাব থাকে। এক্ষেত্রে তদন্তকারীদের সঙ্গে মানব পাচারকারীদের লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে তদন্তকারীরা মানব পাচারকারীদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের আগে হলে হয়তো এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনই গ্রহণ করা হতো। এখানেই রাষ্ট্রের বড় ব্যর্থতা যে যাদের কাছে আমরা নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করি, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখন অপরাধীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে এবং দেশের সম্মান নষ্ট করছে। আমরা যদি একমাত্র মালয়েশিয়ার কথাই চিন্তা করি যে কত মানুষকে এ চক্রগুলো ভুল তথ্য দিয়ে সেখানে পাঠিয়েছে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেকেই কারাগারে রয়েছে। এ সিন্ডেকেটকে রাষ্ট্র ভাঙতে পারেনি। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি শুধু মৌখিক। রাষ্ট্র এখানে যদি সব মানুষের জন্য, বিশেষ করে যারা বিদেশে যেতে চান তাদের যথাযথ খরচের মাধ্যমে পাঠানোর কাজটা সম্পন্ন না করে তাহলে রেমিট্যান্স কীভাবে বাড়বে।’
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে জনশক্তি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ও মামলার অন্যতম আসামি নাফিসা কামাল কৌশলে দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও গত বছরের ২০ অক্টোবর ঢাকার বনানী থেকে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। পরে তাকে সিআইডির করা মানব পাচার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার চাপে পড়ে এ সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। এ সময় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েও নিরুপায় ছিলেন বলে দাবি করেন ইমরান আহমেদ। পরবর্তী সময়ে তার সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় ছয় বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের আগস্টে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো আবার শুরু হয়। তবে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার কর্মী যাওয়ার পর নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায় ১৭ হাজার অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মী আর যেতে পারেননি। মালয়েশিয়া সরকার ২৫টি বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়, যেগুলো ‘সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিতি পায়। এর পেছনে চারজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা ছিল। সিন্ডিকেটের মালয়েশিয়া অংশের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম আবদুন নুর। আর বাংলাদেশ অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন। সরকার প্রত্যেক কর্মীর অভিবাসন ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে প্রতিজনের কাছ থেকে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশী অংশের নিয়ন্ত্রকেরা প্রতিজনের কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার ও মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রকেরা ভিসাপ্রতি প্রায় দেড় লাখ টাকা আদায় করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন। কিন্তু বহু অপরাধের হোতা হয়েও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। জনশক্তি রফতানিতে তার সিন্ডিকেটের ব্যাপক জালিয়াতি ও দুর্নীতির তথ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে। এর ফলে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ওই সিন্ডিকেট। আবারো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দখল করার চেষ্টা করছে তারা।
জনশক্তি রফতানির এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা রুহুল আমিন স্বপন ও মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নুর ওরফে দাতো শ্রী আমিন। স্বপন-আমিন সিন্ডিকেট ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পর চড়া দামে কর্মী পাঠিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। স্বপন ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডি জানায়, রুহুল আমিনের জনশক্তি রফতানির প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বনানী ও উত্তরা এলাকায় সাতটি দলিলে ২৩১ কাঠা জমি রয়েছে। এসব জমির দলিল মূল্য ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এসব জমির ওপর ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন অবকাঠামোসহ ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির সিন্ডিকেটের প্রধান রুহুল আমিনসহ সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে একটা মামলাও দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব মানব পাচারকারীর সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’