বাংলাদেশে আরেকটি সক্রিয় ভূগর্ভস্থ ফাটলরেখার (ফল্টলাইন) সন্ধান পেয়েছে ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল। এটি বাংলাদেশের জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ কিলোমিটার।
ফাটলরেখাটির একটি অংশ ভূমিকম্পপ্রবণ, যা বাংলাদেশের ভেতরেও পড়েছে। এটি সর্বোচ্চ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে বলে তথ্য উঠে এসেছে গবেষণায়।
ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা দেশে দুটি প্রধান ফাটলরেখা থাকার কথা বলে আসছিলেন। তা হলো ডাউকি ফাটলরেখা এবং ইন্দোবার্মা মেগাথ্রাস্ট (মেগাথ্রাস্ট হলো পৃথিবীর বড় প্লেটগুলো একে অপরের নিচে চাপ দেওয়ার কারণে তৈরি হওয়া বড় ভূমিকম্প-সৃষ্ট ফল্ট বা চ্যুতি)। এর বাইরে সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় ফাটলরেখা, মধুপুর, শাহজিবাজার, জাফলং ও কুমিল্লা ফাটলরেখা রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন খোঁজ পাওয়া ফাটলরেখাটি যোগ হলো।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আক্তারুল আহসানের নেতৃত্বে এক গবেষণায় নতুন খোঁজ পাওয়া ফাটলরেখা চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক ও বাংলাদেশের কয়েকজন গবেষক।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আক্তারুল আহসানের নেতৃত্বে এক গবেষণায় নতুন খোঁজ পাওয়া ফাটলরেখা চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক ও বাংলাদেশের কয়েকজন গবেষক।
আক্তারুল আহসান যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প নিয়ে পিএইচডি করছেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে সহ–পরামর্শকদের একজন হলেন ভূ-পদার্থবিদ মাইকেল এস স্টেকলার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির অধ্যাপক।
আক্তারুল আহসান প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৪ থেকে ১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের আয়োজনে ছয় দিন ধরে আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। সেখানে এ গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল তুলে ধরা হবে।
ফাটলরেখাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটার এক ভাগে স্বল্প মাত্রা এবং দ্বিতীয় ভাগ বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তৃতীয় ভাগে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নেই।আক্তারুল আহসান, উপপরিচালক, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর
আক্তারুল আহসান বলেন, তিনি ও তাঁর দল ২০২৪ সালের মার্চে ‘টেকটোনিক জিওমরফলোজি’ পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু করেন। সম্প্রতি গবেষণাটি শেষ হয়। এ গবেষণায় ফাটলরেখাটি শনাক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ফাটলরেখাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটার এক ভাগে স্বল্প মাত্রা এবং দ্বিতীয় ভাগ বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তৃতীয় ভাগে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নেই।
অবশ্য কোন অংশে ঝুঁকি বেশি, কোথায় কম, তা বিস্তারিতভাবে এখনই প্রকাশ করতে চান না আক্তারুল আহসান। তিনি বলেন, গবেষণাটি নিয়ে একটি নিবন্ধ শিগগিরই বিশ্বখ্যাত একটি জার্নালে প্রকাশিত হবে। সেখানে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।
বাংলাদেশে ২১ ও ২২ নভেম্বর দুই দিনে চার দফা ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এই ভূমিকম্পে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েক দফা ভূমিকম্প হলেও এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ভূমিকম্পে সৃষ্ট কম্পন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
নতুন শনাক্ত ফাটলের সঙ্গে বড় মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনো চলছে।
নতুন গবেষণায় আরেক ফাটলরেখা
নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, নতুন করে চিহ্নিত হওয়া ফাটলরেখার জন্ম ৫ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে। এ সময়কালকে ভূতত্ত্ববিদ্যার ভাষায় বলা হয় ইউসিন যুগ। সে সময় সক্রিয় থাকা এ ফাটলরেখা ২ কোটি ৩০ লাখ বছর নিষ্ক্রিয় ছিল। নিষ্ক্রিয়তার এ সময়কালকে বলা হয় মায়োসিন যুগ। ৫৬ লাখ বছর আগে ভূত্বকের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট (যে প্লেটের ওপর উপমহাদেশ ও এর আশপাশের অঞ্চল অবস্থান করছে) ও ইউরেশিয়ান প্লেটের (এশিয়া ও ইউরোপ যে প্লেটের ওপর অবস্থান করছে) ক্রমাগত চাপের ফলে মেঘালয়ের পর্বতমালা মাটির নিচ থেকে উঠে আসার পর এ ফাটলরেখা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর ভেতরের চাপ বা ধাক্কায় ভূমির আকৃতি ও রূপরেখায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবর্তনকে টেকটোনিক মরফোলজি বলা হয়। নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতিবছর ৪৬ মিলিমিটার বা ৪ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই গতি একেক সময় একেক রকম ছিল। কখনো সোজা উত্তর দিক বরাবর, আবার কখনো উত্তর–পূর্ব দিক বরাবর এ গতি পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো গতিবেগ বেশি ছিল, কখনো কম। ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতির জন্যই ডাউকি ফাটল এবং নতুন আবিষ্কৃত এ ফাটলের জন্ম হয়েছে।
ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতি বেঙ্গল বেসিনের আরও অনেক ফাটলের জন্ম দিয়েছে জানিয়ে গবেষক আক্তারুল আহসান বলেন, এর ভেতর কিছু ফাটল ভূমিকম্প তৈরির সামর্থ্য রাখে, কিছু রাখে না। নতুন শনাক্ত ফাটলের সঙ্গে বড় মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনো চলছে।
আমাদের এখানে ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা হলো অনেকগুলো ফল্টলাইন বা ফাটলরেখা আছে। গবেষণা করলে এ অঞ্চলে এ রকম আরও ফাটলরেখার সন্ধান মিলবে।ফাটলরেখা থাকা মানেই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হবে, তা বলা যায় না।আশরাফুল আলম, সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নতুন শনাক্ত ফাটলরেখার সঙ্গে সরাসরি যে কটি ভূমিকম্পের সম্পর্ক পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ অন্যতম। এটি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার ২০১০ সালে এক গবেষণা নিবন্ধে বলেছিলেন, সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭। উৎসস্থল ছিল মানিকগঞ্জ। মধুপুর ফাটলরেখায় এই ভূমিকম্প হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ চার্লস স্টুয়ার্ট মিডলম্যাসের গবেষণার বরাত দিয়ে হুমায়ুন আখতার লিখেছেন, এই ভূমিকম্পের কম্পন ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত, ভুটান ও মিয়ানমারের কিছু এলাকায়। তখন অন্তত ৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, যার ৪০ জনই ছিলেন শেরপুরের। ভূমিকম্পটিতে ময়মনসিংহে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
১৯২৩ সালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ এলাকায় আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যেটি ইউএসজিএসের (মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা) আর্থকোয়েক ক্যাটালগে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। এটির সঙ্গেও নতুন চিহ্নিত হওয়া ফাটলরেখার সম্পর্ক রয়েছে বলে আক্তারুল আহসানের গবেষণায় উঠে এসেছে।
নতুন গবেষণাটিতে ‘মর্ফোলজিক্যাল চেঞ্জ’ বিষয়ে স্যাটেলাইট ম্যাপিং দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা হলো অনেকগুলো ফল্টলাইন বা ফাটলরেখা আছে। গবেষণা করলে এ অঞ্চলে এ রকম আরও ফাটলরেখার সন্ধান মিলবে। তিনি বলেন, ফাটলরেখা থাকা মানেই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হবে, তা বলা যায় না।
ভূমিকম্প হলে ধরে নেওয়া যায় যে একটা ফাটল আছে। কিন্তু সে ফাটলের ব্যাপ্তি কত, সে ফাটলে কত শক্তি সঞ্চিত আছে এবং সে ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি কত বছর পর ঘটতে পারে, সেগুলো বের করাই গবেষকের কাজ। আশা করা যায়, গবেষণায় তিনি (আক্তারুল) সেটি বিস্তারিত বের করবেন।
দেশে ৩৩টি বড় ভূমিকম্প
ভূমিকম্পবিশেষঞ্জ হুমায়ুন আখতারের ২০১০ সালের একটি গবেষণায় ১৫৪৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার, আসাম, শিলং ও বাংলাদেশে আঘাত হানা ৩৩টি শক্তিশালী ভূমিকম্পের একটি তালিকা করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন হওয়া ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটিতে মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এর বাইরে ১৮৪৬ সালে ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে ময়মনসিংহে, ১৮৪২ সালে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে পাবনায় ভবনধসের তথ্য দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। ১৮২২ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে ময়মনসিংহে ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৮১২ সালের ১০ এপ্রিল ও একই বছরের ১১ মে দুটি ভূমিকম্পে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। রিখটার স্কেলে মাত্রা উল্লেখ না করলেও এ ভূমিকম্প দুটিতে তেজগাঁও এলাকায় কয়েকটি ভবন ধস হয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯১৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গল ও আশপাশের অঞ্চলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশ ও আসামে মারা গিয়েছিলেন ৯ জন। ১৯২৩ সালে মেঘালয়ে একটি ভূমিকম্প হয়। মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ১। এর কম্পনে ময়মনসিংহে ৫০ জনের মৃত্যু হয়।
নতুন ফাটলরেখা নিয়ে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ভূমিকম্পবিষয়ক ভূতত্ত্ববিদ এ কে এম খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আক্তারুল আহসান যে গবেষণাটি করছেন, সেটা আমি জানি। তিনি যে আধুনিক প্রযুক্তি টেকটোনিক মর্ফোলজি ব্যবহার করে এ ফাটলরেখা শনাক্ত করেছেন, সেটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।’ তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প হলে ধরে নেওয়া যায় যে একটা ফাটল আছে। কিন্তু সে ফাটলের ব্যাপ্তি কত, সে ফাটলে কত শক্তি সঞ্চিত আছে এবং সে ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি কত বছর পর ঘটতে পারে, সেগুলো বের করাই গবেষকের কাজ। আশা করা যায়, গবেষণায় তিনি সেটি বিস্তারিত বের করবেন।