Image description

সাব্বির হোসেন মুন্না বাড়ি ফিরে আসবেন—এই অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন মা মুক্তা বেগম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান মেলেনি তাঁর। ‘ছেলে হয়তো কোথাও আছে’ এতটুকু আশা ছিল মায়ের বুকে। গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল থেকেই এই আশায় বসে ছিলেন তিনি।

১৬ মাস পর মা মুক্তা বেগমের অপেক্ষার শেষ হয়েছে। গত সোমবার তিনি জানতে পেরেছেন, ছেলে আর ফিরবেন না কোনো দিন। তাঁকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে। এখন কবরের সন্ধান পেয়েছেন, এটুকুতেই সান্ত্বনা খুঁজছেন তিনি।

গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিনে ভোরে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী সাব্বির। এরপর আর ফেরেননি।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দমন–পীড়নে কয়েক শ মানুষ নিহত হন ৫ আগস্টের আগেই। সেদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার আগে–পরেও পুলিশের গুলিতে নিহত হন অনেকে।

নিহত সবার পরিচয় তখন জানা যায়নি। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সাব্বিরও ছিলেন, তা এখন ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেল।

শেষ হলো অপেক্ষা

মুঠোফোনে মুক্তা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এত দিন আশায় ছিলাম। মনে হইছিল অন্য কোথাও আছে। কিন্তু পাইলাম না। পরে শুনলাম, ছেলে নাই। এখন অন্তত জানতেছি—লাশটা কই আছে।’

ডিএনএ পরীক্ষায় মুক্তা বেগম নিশ্চিত হয়েছেন নিখোঁজ ছেলে সাব্বির আর ফিরবে না। ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে যে লাশটি জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে, তা সাব্বিরের। ৪৭৭ দিন বা প্রায় ১৬ মাস পর ছেলের এই খোঁজ পাওয়াটাই এখন এ পরিবারের একমাত্র সান্ত্বনা।

গত বছরের ১৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় মুক্তা বেগম সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ২৪ বছর বয়সী ছেলে সাব্বির ৫ আগস্ট কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হন।

রোড নং-১১, লাইন উত্তর (পশ্চিম ১০), কবর নং-২০, জুরাইন কবরস্থান—চিরকুটে লেখা এই ঠিকানায় দাফন করা হয়েছে সাব্বিরের লাশ
রোড নং-১১, লাইন উত্তর (পশ্চিম ১০), কবর নং-২০, জুরাইন কবরস্থান—চিরকুটে লেখা এই ঠিকানায় দাফন করা হয়েছে সাব্বিরের লাশছবি: পরিবারের সৌজন্যে

মুক্তা বেগম বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট সাব্বির ছোট বোন সুমাইয়া আক্তারকে জানিয়েছিলেন, আন্দোলনে তাঁর পেছনে থাকা একজনের মাথায় গুলি লেগে গুলি বের হয়ে গিয়েছিল। এসব শুনে ছেলেকে আর আন্দোলনে না যেতে বুঝিয়েছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট যেন ছেলে বাইরে যেতে না পারেন, সে চেষ্টাও করেছিলেন। তবে ছেলে সেদিন সকালে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

২০ নভেম্বর ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অব বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষায় অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেছে। ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, অজ্ঞাত মৃতদেহটি মো. শফিকুল ইসলাম ও মুক্তা বেগমের সন্তানের।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এই ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া নথির পাশাপাশি মুক্তা বেগমের পরিবারের কাছে ছোট একটি চিরকুটও আছে। তাতে লেখা—রোড নং-১১, লাইন উত্তর (পশ্চিম ১০), কবর নং-২০, জুরাইন কবরস্থান।

সংসারের ভরসা হারালেন মা–বোন

মঙ্গলবার মুঠোফোনে কথা হয় মুক্তা বেগম ও সাব্বিরের ছোট বোন সুমাইয়ার সঙ্গে। তাঁদের বাড়ি নীলফামারী হলেও নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন ১৫ বছর ধরে। মা–বাবার সঙ্গে সাব্বিরও একই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তিনজনের আয় দিয়ে চলত সংসার। সাব্বিরের বেতন ছিল প্রায় ১৮ হাজার টাকা। তাঁর নিখোঁজের পর থেকে মা অসুস্থ হয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এ কারণে ১৫ বছর বয়সী ছোট বোন সুমাইয়ার মাদ্রাসার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

জুলাই আন্দোলনের সময় সাব্বির নিয়মিত মিছিলে যেতেন—এ তথ্য পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন গত বছরের ৪ আগস্ট। আর ৫ আগস্ট তিনি নিখোঁজ হন।

২০ নভেম্বর ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অব বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষায় অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেছে। ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটি মো. শফিকুল ইসলাম ও মুক্তা বেগমের সন্তান।

সাব্বিরকে বিয়ে করাবেন—এই আশায় কনে দেখা শুরু করেছিলেন মুক্তা বেগম। আরও স্বপ্ন দেখেছিলেন, ছেলে বড় হয়েছে, বিয়ে করে সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন নিভে যায় ৫ আগস্টেই।

সাব্বিরের ছোট বোন সুমাইয়া জানান, গত বছরের ৪ আগস্ট আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর একটি অটোরিকশায় বসে থাকা সাব্বিরের ছবি তুলেছিলেন তাঁদের পরিচিত একজন। সেটাই তাঁর ভাইয়ের জীবিত অবস্থার দেখা শেষ ছবি। এখন ভাই বলতে, অচেনা এক কবরের ইতিহাস।

হয়রানি আর অপমানের ৪৭৭ দিন

ছেলের খোঁজে মুক্তা বেগম ঘুরেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোনারগাঁও ও শাহবাগ থানায়, মালিবাগ সিআইডি অফিসে।

ছেলের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মুক্তা বেগম। অপমানও হতে হয়েছে তাঁকে। এত দিন ধরে এই দৌড়ঝাঁপ করতে করতে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

মুক্তা বেগম বললেন, ‘অনেক দিন ধইরা ঘুরছি। ঢাকা মেডিকেলের মর্গ, সোনারগাঁও থানা, শাহবাগ থানা, মালিবাগের সিআইডি অফিস—একবার না, একেক জায়গায় কয়েকবার কইরা ঘুরছি। এক জায়গায় গেলে কয় ওই জায়গায় যান, ওইখানে যাওনের পর কয় এই দায়িত্ব নাকি তাঁদের না। ঢাকা মেডিকেলে কয়েকটা লাশও দেখায়, কিন্তু আমার ছেলেরে পাই না।’

আমি তো মা, আমি বুঝতে পারি। আমি চিনব না আমার ছেলেরে। নাক, মুখ যেটুকু বোঝা যায়, তাই দেখে বলি—এই আমার ছেলে।
মুক্তা বেগম, সাব্বিরের মা

‘ছেলেরে খুঁজতে গেছি, তখন হয়রানি ও অপমানও করছে অনেকে। কোনো কোনো জায়গায় টাকাও চাইছে কেউ কেউ। কবিরাজও ধরছি। এই করতে করতে নিজেই অসুস্থ হইয়া যাই’—এভাবে বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠেন মুক্তা বেগম।

বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি জানতে পারেন, আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছেন এমন ছয়জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে আছে। থানা, পুলিশ, সাংবাদিক এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন হয়ে ছেলের সন্ধান পান এই নারী।

ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, অজ্ঞাতনামা মৃতদেহটি মো. শফিকুল ইসলাম ও মুক্তা বেগমের সন্তাননের
ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, অজ্ঞাতনামা মৃতদেহটি মো. শফিকুল ইসলাম ও মুক্তা বেগমের সন্তাননেরছবি: পরিবারের সৌজন্যে

‘বেওয়ারিশ’ লাশ যেভাবে পরিচয় পেল

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষিত ছয়টি বেওয়ারিশ লাশের তথ্য প্রথমে সামনে আনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেল। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বেওয়ারিশ লাশগুলো শনাক্ত করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় এ সেল। এরপর গত আগস্টে লাশগুলো জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এ সেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এবং বর্তমানে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কমিউনিকেশন অফিসার সাইদুর রহমান শাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের খোঁজ নেই বলে মুক্তা বেগম সম্প্রতি তাঁকে ফোন করে জানিয়েছিলেন। পরে মুক্তা বেগমকে সব কাগজপত্র নিয়ে ফাউন্ডেশনে আসতে বলা হয়।

ডিএনএ পরীক্ষায় মুক্তা বেগম নিশ্চিত হয়েছেন নিখোঁজ ছেলে সাব্বির আর ফিরবে না। ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে যে লাশটি জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে, তা তাঁর ছেলের। ১৬ মাস পর ছেলের এই খোঁজ পাওয়াটাই এখন এ পরিবারের একমাত্র সান্ত্বনা।

মুক্তা বেগম ফাউন্ডেশনে আসার পর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবরের তত্ত্বাবধানে শাহবাগ থানায় নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সব প্রক্রিয়া শেষে ডিএনএ পরীক্ষায় তাঁর ছেলের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সাইদুর রহমান।

শাহবাগ থানায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া বিকৃত একটি লাশের ছবি দেখানো হয়েছিল মুক্তা বেগমকে। সেই ছবি দেখেই মুক্তা বেগম বুঝতে পেরেছিলেন—এটা তাঁরই ছেলের লাশ। তিনি বলেন, ‘আমি তো মা, আমি বুঝতে পারি। আমি চিনব না আমার ছেলেরে? নাক, মুখ যেটুকু বোঝা যায়, তাই দেখে বলি—এই আমার ছেলে।’

এরপরই ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে মৃত্যু হয়ে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা বেওয়ারিশ ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে জটিলতা পোহাতে হচ্ছে। কারণ, এসব কবরে কোনো চিহ্ন বা লাশ শনাক্ত করার কিছু নেই। অনেক পরিবার শুধু জানতে পেরেছে, এই কবরস্থানে স্বজনের লাশ আছে, তবে কবর কোনটি, তা চিহ্নিত করার উপায় নেই। গত ৪ আগস্ট এই ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে দেহাবশেষ তোলার নির্দেশ দেন আদালত।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয়টি বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে কবর শনাক্তের বিষয়টি মাথায় রেখে দাফন করা হয় বলে জুরাইন কবরস্থানের মোহরার আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন।

ছেলেরে খুঁজতে গেছি, তখন হয়রানি ও অপমানও করছে অনেকে। কোনো কোনো জায়গায় টাকাও চাইছে কেউ কেউ। কবিরাজও ধরছি। এই করতে করতে নিজেই অসুস্থ হইয়া যাই।
মুক্তা বেগম, সাব্বিরের মা

আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ কবরস্থানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ১৬ জন শহীদের লাশ দাফন করা হয়েছে। এই কবরগুলোর পাশেই এই ছয় লাশ দাফন করা হয়েছে। সিরিয়াল নম্বর, লাইন নম্বর, ময়নাতদন্তের কোড নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করা আছে। ডিএনএ মিলে গেলে পরিবার এসে স্বজনের কবর দেখতে চাইলে তা জানানো সম্ভব।

শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি লাশের মধ্যে গত সোমবার একটির ডিএনএ নমুনা তাঁর মা–বাবার ডিএনএর সঙ্গে মিলেছে। অন্য লাশগুলোর দাবিদার এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। আর ডিএনএ মেলার পর পরিবারগুলো লাশ নিতে চাইলে করণীয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।