আগুনে পুড়ে গেছে ইমনুর জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, স্বপ্ন আর আশ্রয়। তিন মেয়েকে নিয়ে এখন খোলা আকাশই তাদের একমাত্র ছাদ। বড় মেয়ের বয়স ১০ বছর, মাঝেরটির ৭, আর সবচেয়ে ছোটটি মাত্র দুই বছরের শিশু। আগুনের লেলিহান শিখায় সবকিছু হারিয়ে ছোট মেয়েটির পড়ার মতো একটি কাপড়ও বের করতে পারেননি তিনি। ছোট শিশুটি বারবার কাঁদছে, আর মা ইমনু অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন সন্তানদের দিকে। ‘মা আমদের ঘর কই’ দুই বছরের সন্তানের এমন প্রশ্নের উত্তর নেই মা ইমনুর কাছে।
ইমনু অসহায় হয়ে বলেন, আগুন লাগার সময় ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না। আমরা তিনজন মা আর তিন বাচ্চা, কেউই কিছু বের করতে পারিনি। চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বাচ্চারা আতঙ্কে চিৎকার করছিল, আর আমার হাত-পা কাজ করছিল না। ছোট মেয়ে বারবার আমাকে ধরে বলছে ‘মা, আমাদের ঘর কই?’ আমি কী উত্তর দেব? আমার নিজেরই তো কিছু নেই, ঘর নেই, পোশাক নেই, রান্নার হাঁড়ি-পাতিল নেই; কিছুই নেই। গত রাতের শীতে যে কাপড়টা মেয়েটার গায়ে ছিল, আগুনে সেই কাপড়ও কালিতে মাখামাখি হয়ে গেছে। এখন ও খালি শরীরে আছে। আমি কোনোভাবেই তাকে ঢাকার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।
ইমনু জানান, এই বস্তিতেই তার জন্ম, এই বস্তিতেই তার বেড়ে ওঠা। প্রায় ত্রিশ বছরের জীবনে তিনি একটাই ঠিকানা জানতেন, কড়াইল বস্তি। এখানেই বিয়ে হয়েছে, এখানেই প্রথম সন্তান কোলে এসেছে, এখানেই সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু সেই সংসার বারবার ছাই হয়ে গেছে আগুনে। ত্রিশ বছরে প্রায় ১১ বার আগুন লাগার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে তার। বিশেষ করে তিনবার বড় আগুনে পুরো বসতি ছাই হয়ে গিয়েছিল, আর তিনবারই তিনি হারিয়েছিলেন নিজের ঘর, নিজের সামান্য সংগ্রহ।
কথা বলতে বলতে ভার হয়ে যায় ইমনুর কণ্ঠ। তিনি বলেন, প্রতিবারই আগুনে সবকিছু হারাই, আবার খুঁটিনাটি জোগাড় করে দাঁড়াই। ভেবেছি বাচ্চাদের মানুষ করব, ওদের জন্য একটা দিন ভালো আসবে। কিন্তু এই আগুন আমাদের আবার শূন্য করে দিল। এত কষ্টে সংসার করি, কিন্তু আগুনে সব মুহূর্তেই শেষ।
আগুন বিস্তৃতির জন্য ফায়ার সার্ভিসকে দায়ী করেন ইমনু। অভিযোগ করে তিনি বলেন, এ বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লাগে তিনবার। ২০০৪ সালে, ২০১৬ সালে এবং সর্বশেষ গতকালকে (২৫ নভেম্বর)। এর আগেরবার ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে দ্রুত আসলেও এবার ফায়ার সার্ভিস আসতে অনেক দেরি করলো। আগুন যখন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন একটুখানি পানির ধারা পেলেই কতগুলো ঘর বাঁচানো যেত। কিন্তু তারা সময়মতো আসেনি। তাদের এই অবহেলার কারণেই আমাদের পুরো একটা পাড়া পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
কথা বলতে বলতে ইমনু বারবার ভেঙে পড়ছিলেন। তিন কন্যাকে আঁকড়ে তিনি শুধু একটি কথাই বলছিলেন, বাচ্চাগুলারে নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব? রাত হলে আমরা কোথায় ঘুমাব? আমার ছোট মেয়েটাকে কীভাবে শীত থেকে বাঁচাব? আল্লাহ ছাড়া আজ আমাদের আর কেউ নেই।
এদিকে বুধবার (২৬ নভেম্বর) কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সেই ক্ষতচিহ্ন একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে এখন অসংখ্য মানুষের ঠাঁই হয়েছে
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পরিজনসহ উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে খুঁজছেন পোড়া কাঠামোর ভেতর বেঁচে থাকা সামান্য কিছু জিনিস; কারও হাতে অর্ধদগ্ধ কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই। চারদিকে শুধু পুড়ে যাওয়া টিন, কংক্রিট ও কাঠের গন্ধ।
প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট টানা কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে অন্তত দেড় হাজার ঘর ও দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘটনাটির কারণ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে।