Image description

‘তিনবার আগুনে পুড়লাম। ২০০৪, ২০১৭ এবং এবার ২০২৫ সালে আবার পুড়লাম।’-কথাগুলো বলছিলেন আলেয়া বেগম (৫০)। কণ্ঠ তার কান্নায় ভেজা। রাজধানীর কড়াইল বস্তির বউ বাজার সংলগ্ন অংশে বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকালেও ধোঁয়া উড়ছিল, আর সে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আলেয়া যেন হারানো জীবনের হিসাব মেলাচ্ছিলেন।

মাত্র দু'দিন আগে ব্যবসার জন্য দুই লাখ টাকা লোন নিয়েছিলেন তিনি। আগুন লাগার সময় ভাগ্যক্রমে ছেলে-মেয়েরা কেউ ঘরে ছিল না, কিন্তু সে ভাগ্য তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। “থাকলে অন্তত প্রয়োজনীয় জিনিস ও টাকা পয়সা উদ্ধার করতে পারতাম। এখন সব টাকা পুড়ে ছাই। সব আত্মীয় স্বজনের ঘর পুড়ে ছাই, একজন যে আরেক জনকে সাহায্য করবে এমন ব্যবস্থা নেই। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি,” বাংলানিউজকে বলছিলেন তিনি।

আলেয়া বেগমের ঘর ও দোকানসহ পুড়েছে মোট পাঁচটি কাঠামো। কিন্তু এ আগুন শুধু তার জীবন নয়, কেড়ে নিয়েছে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের স্বপ্ন।

সিলিন্ডারের অভিশাপ আর যেভাবে ছড়াল লেলিহান শিখা
সরেজমিনে গুলশান লেকের গুদারা ঘাট সংলগ্ন কড়াইল কবরস্থান বস্তিতে দেখা যায় এক বিস্তীর্ণ ধ্বংসস্তূপ। বস্তির সরু গলিপথ, যেখানে দুটি রিকশার যাতায়াতই কষ্টকর, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে চরম বেগ পেতে হয়েছে। বস্তির ভেতরের রাস্তা এতটাই সংকীর্ণ যে দু'জন পাশাপাশি হেঁটে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব।

এ বস্তির অধিকাংশ ঘরই বাঁশ ও টিনের তৈরি। ধ্বংসলীলার মাঝে অক্ষত দাঁড়িয়ে আছে কেবল কয়েকটি পাকা বাড়ি, যেন তা কোনো এক নির্মম নিয়তির সাক্ষী।

আগুন লাগার সূত্রপাত আলেয়া বেগমের ভাড়া দেওয়া চায়ের দোকানে পাশের আরেকটি চায়ের দোকান থেকে। দোকানের ভাড়াটিয়া রোকসানা তখনও দোকানেই ছিলেন। তিনি জানান, তার দুই দোকান পরেই আগুন লাগে। সবাই মিলে নেভানোর চেষ্টা করলেও দোকানে থাকা সিলিন্ডার ব্লাস্ট হলে মুহূর্তে আগুন আশপাশের দোকান এবং তার দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের প্রভাবে সেই আগুন দ্রুত গোটা বস্তিকে গ্রাস করে।

রোকসানার নিজের দেড় লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। তিনি আরও জানান, ‘বছর দেড়েক আগে এ বস্তির সমস্ত সরকারি গ্যাসের লাইন অবৈধ বলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সবাই সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করে। আগুন লাগার পর এ সিলিন্ডারের কারণেই ক্ষতি বেশি হয়েছে। আগুন লাগার পর একে একে সব সিলিন্ডার বিস্ফোরণ শুরু হয়, যার ফলে আগুনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।’

রাতভর খোলা আকাশের নিচে বস্তিবাসী
পুড়ে যাওয়া বস্তির কিছুটা সামনেই 'বায়তুল মা'মুর জামে মসজিদ' অক্ষত থাকলেও তার ওপরের টিনের ঘরগুলো পুড়ে ছাই। সেখানেই গত পাঁচ বছর ধরে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন মোস্তাক আহমেদ রাফি (২৫), যিনি গুলশানের একটি হোটেলের রুটির কারিগর।

আগুন লাগার পর পুরো শীতের রাত তাকে কাটাতে হয়েছে গুলশানের রাস্তায় ঘুরে। সকালে আগুন নির্বাপণের ঘোষণা এলে তিনি রুমে আসেন। কিছু অবশিষ্ট আছে কি না দেখতে। থাকার কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় এখন গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ যাওয়ার চিন্তা করছেন রাফি।

ভারাক্রান্ত কণ্ঠে রাফি বলেন, ‘এই বস্তির অধিকাংশই ভাড়াটিয়ার এখন সামনে সব থেকে বড় সমস্যা হবে থাকার। শীতের রাতে এভাবে বাইরে থাকা কষ্টকর। গতকাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি, এই আগুনের টেনশনে।’

মায়ের শখের সেলাই মেশিনটি আর নেওয়া হলো না
রাফি যখন তার মেস থেকে অবশিষ্ট মালপত্র খুঁজছিলেন, তখন মসজিদের ছাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের ধ্বংসস্তূপ দেখছিল দশ বছরের শিশু জিয়ান। কেঁদে কেঁদে সে বলতে থাকে, ‘মায়ের শখের সেলাই মেশিনটি আর নেওয়া হলো না।’

জিয়ানের পরিবারের একমাত্র উপার্জনের উৎস ছিল এ সেলাই মেশিন। মা, বাবা, বোন ও খালা থাকতেন পুড়ে যাওয়া এ ঘরটিতে। আগুন লাগার পর মা শুধু একটি ট্র্যাঙ্ক নিয়ে বের হতে পেরেছিলেন। পরে শখের সেলাই মেশিনটি আনতে গেলে আগুনের তীব্রতায় সেটি আর নেওয়া হয়নি।

এ শীতের রাতে জিয়ানের ঠাঁই হয়েছে বস্তির সামনে গুলশান লেকের পাশে একটি উঁচু দালানের রাস্তার ধারে। রাতে এক ভবনের লোক খাবার দিলেও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক কাপ চা আর রুটি ছাড়া তার কিছু খাওয়া হয়নি।

‘পুড়ে যাওয়া ঘরে সেলাই মেশিনটির জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে,’ জানাল জিয়ান। ‘এটি যদি বাঁচানো সম্ভব হত তাহলে এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম। ঘরে বাবা অসুস্থ, মা এটি চালিয়ে সবার খরচ চালাতেন।’

মধ্যবিত্তের আক্ষেপ, ‘এক জায়গা থেকে নিঃস্ব হয়ে এসেছি, আবার নিঃস্ব হলাম।’মধ্যবিত্ত পরিবারের সালেহা বেগম (ছদ্মনাম) স্বামীর ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় বাধ্য হয়ে ছয় মাস আগে এ বস্তিতে এসে ওঠেন। তিনি বলেন, তাদের এখানে থাকার কথা কোনো আত্মীয়স্বজন জানে না।

সালেহা বেগম (ছদ্মনাম) বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কপালটাই খারাপ এক যায়গা থেকে নিঃস্ব হয়ে এখানে আসলাম, আবার এখানে আগুনে নিঃস্ব হলাম।

আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে থাকা সালেহা বেগমের চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছিল, যেন তার আফসোসের গল্পের কোনো শেষ নেই।

এ আগুন শুধু দেড় হাজার ঘরকে ছাই করেনি, হাজারো মানুষের জীবনের চাকা থামিয়ে দিয়েছে। বারবার ঘটা এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কড়াইল বস্তির বাসিন্দাদের জন্য এক স্থায়ী অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।