প্রায় পাঁচ ঘণ্টা টানা চেষ্টার পর অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুন। আগুন নেভার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে বস্তির ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আগুনে শতাধিক ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রচুর নারী ও শিশু রয়েছেন। তারা এখন অস্থায়ী আশ্রয়হীন। পরিবারের অভিভাবকরা উদ্ধার কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও ক্লান্ত শরীরে খোলা আকাশের নিচে যেখানে জায়গা পেয়েছেন, সেখানে ঘুমিয়েছেন। অধিকাংশ শিশু গায়ে থাকা ভেজা কাপড়েই ঘুমিয়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রাত রাত ১০টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে জানায় ফায়ার সার্ভিস। তবে অস্থায়ী আশ্রয়হীন পরিবারগুলোর অধিকাংশই খামারবাড়ি মাঠে অবস্থান নেন।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম দোলন জানান, রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, বস্তির ঘিঞ্জি এলাকা এবং পানির সমস্যা থাকায় আগুন নেভানোতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে ১৯টি ইউনিট কাজ করেছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
লাভলী বেগম, সাত বছর ধরে কড়াইল বস্তিতে বসবাস করছেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এই নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আগুনে আমাদের সব হারিয়েছি। কিস্তিতে কেনা জিনিস, কিছু জমানো টাকা, কাপড় সব কিছু পুড়ে গেছে। এখন আমাদের বাচ্চারা কোথায় ঘুমাবে, আমরা জানি না। পানিতে ভেজার কারণে তারা শীতে কাঁপতে শুরু করেছে। আমরা সাহায্য চাই, নিরাপদ আশ্রয় চাই।
তার পাশে থাকা ভ্যান চালক স্বামী মোহসিন আলী বলেন, আগুন লাগার সময় আমি একটা ভাড়া নিয়ে গিয়েছিলাম। যখন খবর পেলাম সব ফেলে রেখে দৌড়ে এলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আর কিছুই করতে পারিনি। আমাদের ঘর, আমাদের সব সম্পদ শেষ হয়ে গেছে।
শামসুল ইসলাম নামে আরেক দিনমজুর জানান, মাত্র দুই মাস আগেই তিনি এই বস্তিতে উঠেছেন। তিনি বলেন, আগুনে আমার নতুন জিনিসপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন এত তীব্র ছিল যে আমরা কোনো জিনিসই রক্ষা করতে পারিনি। চারিদিক ধোঁয়া আর আগুনে ঘিরে আমাদের বের হতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
সারারাত কীভাবে কাটালেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বড় মানুষ, আমাদের নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। তারা তার ফুফুর সঙ্গে খামারবাড়ি মাঠের পূর্ব পাশে এক জায়গায় বিছানা করে শুয়ে ছিল। এভাবেই রাত কাটা তাদের।

খাবার-পানির অভাবে চরম কষ্টে ক্ষতিগ্রস্তরা
এদিকে আগুনে বাড়ি-ঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে খাবার এবং পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পরিবারের পুরুষ অভিভাবক আগুন এবং ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নারী ও শিশুদের খাবারের সংকটে পড়তে দেখা গেছে। তবে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এবং জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরা অস্থায়ীভাবে খাবার ও পানি পৌঁছে দিচ্ছে। তবে সংখ্যা কম এবং বিতরণ সব পরিবারে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেকেকই পরিবারের নারী-শিশুদের খালি পেটেই রাত কাটাতে হয়েছে।
লাভলী বেগম নামে এক নারী বলেন, আমরা আশ্রয়হীন, শীতের মধ্যে শিশুদের কী হবে তা ভেবে আমাদের নিঃশ্বাসও ওঠে না। খাবারের ব্যবস্থা নেই, পানি নেই। বাচ্চারা না খেয়েই কান্না করে করে ঘুমিয়েছে।
ভ্যান চালক মোহসিন আলী যোগ করেন, পকেটে যে কয়টাকা ছিল খাবার এনে সন্তান আর বৃদ্ধ মাকে খাবার কিনে দিয়েছি। রাতে আমি কিছু খাইনি। নিরাপদ জায়গা, খাবার এবং পানি—এই তিনটা জিনিস এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি।
স্থানীয় বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন বলেন, এখানে অনেকগুলো ঘরে পুড়েছে। অন্তত দুই হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটিয়েছে। এতো মানুষের জন্য তো কিছু করা যায় না। তারপরও আমরা স্থানীয়রা যতটুকু পারছি করছি। রাতে জামায়াতের ডা. খালিদ সাহেব খাবার-পানি দিয়েছে। এরকম স্থানীয় কিছু সামাজিক সংগঠনও কাজ করেছে।

ঘটনাস্থলে পৌঁছানোই বগ চ্যালেঞ্জ ছিল
ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শুরুতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছানো। প্রথম ইউনিট পৌঁছাতেই প্রায় ৩০–৩৫ মিনিট সময় লেগেছিল। আশেপাশে বিপুল ভিড় এবং গাড়ির উপস্থিতির কারণে বড় গাড়ি নিয়ে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাতে আগুন ‘ডেভলপ স্টেজে’ পৌঁছেছে, ফলে নিয়ন্ত্রণে বেশি সময় লেগেছে।
তিনি আরও জানান, পাইপের সমস্যা ও পানির সীমিত সরবরাহের কারণে কাজের গতিতে বাধা হয়েছে।

মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে ঘটনাস্থলে তীব্র পানি সংকটের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্মীদের বেশ বেগ পেতে হয়। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় কমিটি এখনও আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানাতে পারেনি। তবে কড়াইল বস্তিতে ঘনবসতি, প্লাস্টিক ও কাঠের সরঞ্জাম, এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের অযথা ব্যবহার আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ শুরু করেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার খামারবাড়ি মাঠে অবস্থান করছে। শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, শীতবস্ত্র এবং খাবারের ব্যবস্থা করা জরুরি।