Image description

সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ভূমিকম্পের পর সারা দেশে আতঙ্ক বিরাজ করলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তে দেখা গেছে ভিন্নতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বেশ কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা বিবেচনায় ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করেছে। কিন্তু স্কুল-কলেজ, প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিন্ডারগার্টেনগুলোতে চলছে স্বাভাবিক পাঠদান; বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরাপত্তা বিবেচনায় ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করলেও ছোট্ট শিশুরা প্রতিদিনই নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা দিচ্ছে, যেন কিছুই ঘটেনি। একই পরিস্থিতিতে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত অভিভাবকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে— উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের বাইরে বাকিরা অর্থাৎ শিশু-কিশোররা কি ঝুঁকিমুক্ত? 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার। গত শুক্রবারের (২১ নভেম্বর) ভূমিকম্প যেন এই সতেরো কোটি মানুষই টের পেয়েছে। ঠিক কতদিন আগে দেশবাসী এমন ভূমিকম্প দেখেছে, সেই হিসাবটাও যেন এখন কষা কষ্টসাধ্য। ভূমিকম্পে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বেশকিছু জায়গায় হেলে পড়েছে ভবন। যদিও সবকিছুকে ছাপিয়ে নতুন আলোচনা এখন ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‌বন্ধ ঘোষণা’। 

“স্কুল বন্ধ হয়নি বলে ছেলেকে পাঠাতেই হলো, কিন্তু মনে ভয় ছিল। ও এখনো বোঝে না ভূমিকম্পে কী করতে হয়। আমি ভয় পেয়েছি, ও পারে নাই— এই পার্থক্যের কারণে কি ঝুঁকি কমে যায়?”-অভিভাবক, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থী। 

গত রবিবার (২৩ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও গণমাধ্যমে তাদের ছুটির বিষয়টি চাউর হলেও, তা নাকচ করে দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তার ভাষায়, ‌‘ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে। তাই আতঙ্ক নয়, বরং সতর্কতা ও প্রস্তুতিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক নির্দেশনা ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে।’

স্বভাবতই অভিভাবকদের প্রশ্ন, শিশুরা কি সত্যিই কম ঝুঁকিতে থাকে, নাকি বিষয়টি তারা বুঝতে না পারায় ভয়ের মাত্রা কম? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, প্রাপ্তবয়স্ক আর শিশুদের ঝুঁকির মধ্যে সত্যিই কোনো পার্থক্য আছে কি?

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সুমি আক্তার নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তার আদরের একমাত্র ছেলে পড়ে রাজধানী ঢাকার একটি কিন্ডারগার্টেনে। তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ হয়নি বলে ছেলেকে পাঠাতেই হলো, কিন্তু মনে ভয় ছিল। ও এখনো বোঝে না ভূমিকম্পে কী করতে হয়। আমি ভয় পেয়েছি, ও পারে নাই— এই পার্থক্যের কারণে কি ঝুঁকি কমে যায়? তিনি মনে করেন, শিশুরা পরিস্থিতি না বোঝার সুবিধায় স্বাভাবিক আচরণ করছে, কিন্তু এতে ঝুঁকি কমে না। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়েও নেতিবাচক মনোভাব দেখান তিনি।

 

লোটাস হাবীব নামে রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত এক মাধ্যমিক স্কুলছাত্রীর বাবা বলেন, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ভূমিকম্পের আতঙ্কে বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ কেন খোলা থাকবে? ভূমিকম্প হলে কি শুধু বড়রাই বিপদে পড়বে, ছোটরা নয়? তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও তো ভাবা উচিত ছিল। 

তিনি আরও বলেন, আমরা তো বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছি দুশ্চিন্তা নিয়ে। কয়েক দিনের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে পরিস্থিতি দেখা যেতে পারত। নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়াটাই তো সবার আগে হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দুর্যোগের সময় একেক মানুষের স্নায়ু একেকভাবে প্রভাবিত হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে আমরা দেখেছি, কিছু শিক্ষার্থী আতঙ্কে বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে আহতও হয়েছে। তাদের মতো স্নায়বিক শক্তির অধিকারী যারা আছেন, তারা তাদের পরিবার ও তাদের নিজেদের বসবাসের স্থানের (আবাসিক হল) ঝুঁকি বিবেচনায় বা সার্বিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার যৌক্তিকতা রয়েছে। আবার করোনা ও জুলাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক্যালি অনেক পিছিয়ে গেছে। সে বিষয় বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করে লস রিকভারের বা বন্ধ না করে বিকল্প কিছুর চিন্তা করতে পারত। আসলে পলিসি গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সঠিক স্ট্যাটিসটিক্স (পরিসংখ্যান) নেই যে, কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ট্রমাটাইজড আছে বা ট্রমাটাইজড নেই। এটা থাকলে মানুষ এসব ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তকে কনশাসলি মূল্যায়ন করতে পারত। 

তিনি আরও বলেন, স্কুল-কলেজের বেশিরভাগই আবাসিক না থাকায় হয়ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বন্ধের সিদ্ধান্তে যায়নি। আর অনুমান বা হাইপোথিক্যালি চিন্তা করে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়াকে হয়ত তারা গুরুত্ব দেয়নি। তারা হয়ত ভাবছে, করোনা মহামারির মতো শিক্ষার্থীদেরকে আর ঘরমুখী করা ঠিক হবে না। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।