আলোচনায় এখন লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল। ১৭ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে ডেনমার্কের মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি সইয়ের পর এই আলোচনা রাজপথে বিক্ষোভেও গড়িয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, পতেঙ্গায় লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে বিদেশি কোম্পানিটি। ৩৩ বছর মেয়াদি এ চুক্তির নানা তথ্য কেন প্রকাশ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
এই প্রেক্ষাপটে কনসেশন চুক্তি আসলে কী? লালদিয়ার কনসেশন চুক্তিতে কী কী আছে, কী কী বিষয় প্রকাশ করা হয়েছে, কী কী বিষয় প্রকাশ করা হয়নি—তা জানার চেষ্টা এই প্রতিবেদনে।
কনসেশন চুক্তি কী
শুরুতে জেনে নিতে হবে, বন্দরের কনসেশন চুক্তিটি আসলে কী? কনসেশন চুক্তি হয় সরকারি–বেসরকারি অংশীদারির প্রকল্পের আওতায় সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো টার্মিনাল উন্নয়ন বা টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তুলে দেওয়া হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে টার্মিনাল নির্মাণ বা উন্নয়ন করে। এর বিনিময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সেবার বিনিময়ে মাশুল আদায় করে। মাশুলের নির্ধারিত অংশ দর–কষাকষির মাধ্যমে পায় সরকারি সংস্থা। বিশ্বজুড়ে বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ ও মুনাফা তুলে নেওয়ার জন্য গড়পড়তা ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে। মেয়াদ শেষে অবকাঠামো সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কনসেশন চুক্তি কি গোপনীয়
কনসেশন চুক্তির দলিল গোপনীয় কি না, তা নির্ভর করে দুই পক্ষের ওপর। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের ঝুঁকি নেয় বলে ব্যবসার জন্য কিছু সুরক্ষা দেওয়া হয়। এ সুরক্ষা মূলত চুক্তিতে থাকা ব্যবসায়িক বিষয়গুলোর ওপর। এ জন্য এসব চুক্তির ব্যবসায়িক বিষয় প্রকাশ না করার বাধ্যবাধকতা থাকে। চুক্তির নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) অংশে এ বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। তবে সব তথ্যই যে প্রকাশ করা যাবে না, এমন বাধ্যবাধকতা থাকে না।
লালদিয়ার চুক্তিতেও ব্যবসায়িক বিষয় প্রকাশে এনডিএ রয়েছে। অর্থাৎ সব বিষয়ই যে প্রকাশ করা যাবে না, তেমন নয়। সরকার চাইলে ব্যবসায়িক বিষয়গুলো ছাড়া অন্য তথ্য প্রকাশ করতে পারে।

বিশ্বের নজির হলো, কনসেশন চুক্তির মূল দলিল সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। ব্যতিক্রম দেখা গেছে ভারতের ক্ষেত্রে। তাদের কনসেশন চুক্তির দলিল প্রকাশ করার নজির রয়েছে। এর বেশির ভাগই নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি। ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের ওয়েবসাইটে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে নেওয়া ২২০টি কনসেশন চুক্তিপত্র দেওয়া আছে, যেখানে বন্দর নিয়ে রয়েছে ২২টি।
বাংলাদেশে লালদিয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের সঙ্গে চুক্তি হয়। ওই চুক্তির সাধারণ কয়েকটি তথ্য ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
লালদিয়ার চুক্তিতে কী কী আছে
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, লালদিয়ার চুক্তির দলিলে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে কনসেশন প্রদান, নির্মাণকাজ শুরুর পূর্বশর্ত, নিরাপত্তা জামানত, প্রকল্পের নকশা, পক্ষগুলোর দায়বদ্ধতা, টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, পরিবেশ ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা, ন্যূনতম সেবার মান, মাশুল, কনসেশন এলাকার মালিকানা ও প্রকল্পের সম্পদের মালিকানা, ক্ষতিপূরণযোগ্য ঘটনা, দৈবদুর্বিপাক (ফোর্স মেজ্যুর) ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঘটনা, চুক্তি বাতিল, বাতিল হলে ক্ষতিপূরণ, গ্রান্টরের (বন্দর কর্তৃপক্ষ) হস্তক্ষেপের অধিকার, তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক—ক্ষতিপূরণ, গোপনীয়তা, বিরোধ নিষ্পত্তি, হস্তান্তর ও মালিকানা বদল ইত্যাদি নানা অনুচ্ছেদ রয়েছে। চুক্তির মূল দলিলের সঙ্গে সংযুক্তি বা পরিশিষ্ট রয়েছে, যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি, আর্থিক, কার্যক্রমগত ও আইনি তথ্যগুলো আলাদা করে বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে।
কী কী প্রকাশ করা হয়েছে
লালদিয়ার চুক্তির দিন কয়েকটি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে—
-
মূল কনসেশন চুক্তিটি ৩৩ বছরের। এর মধ্যে নির্মাণে ৩ বছর এবং বাকি ৩০ বছর পরিচালনার। শর্ত পূরণ হলে আরও ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ আছে।
-
আট লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানো পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২১ ডলার করে মাশুল পাবে। আর আট লাখের বেশি ৯ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানো পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারের জন্য ২৩ ডলার করে পাবে বন্দর। এই দুটি স্তর ছাড়া আরও একটি স্তর রয়েছে। যেমন ৯ লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো–নামানো হলে বন্দরকে আরেকটি স্তরে মাশুল দেবে এপিএম টার্মিনালস। তবে সেই হার কত, তা প্রকাশ করা হয়নি।
-
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানোর তিন জেটির এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কোম্পানিটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
-
চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৫০ কোটি টাকা ‘আপফ্রন্ট ফি’ (এককালীন ফি) পাবে বন্দর।
আরও কী কী আছে
চুক্তি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বর্তমানে বিদেশ সফরে রয়েছেন। বন্দরের অন্য কর্মকর্তারাও কোনো কথা বলছেন না। তবে চুক্তির সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র থেকে বেশ কিছু বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে একটি হলো ১৭ নভেম্বর লালদিয়ার চুক্তি হলেও এটি কার্যকর হবে ৯০ দিন পর। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে প্রজেক্ট কোম্পানি গঠনসহ বেশ কিছু প্রক্রিয়াগত কাজ শেষ করতে হবে বিদেশি কোম্পানিটিকে। ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস ও লোকাল পার্টনার বাংলাদেশের কিউএনএস মিলে এই কোম্পানি গঠন করবে। চুক্তি কার্যকরের সময় আপফ্রন্ট ফির ৫০ শতাংশ পাবে বন্দর। বাকি ৫০ শতাংশ পাবে পরিচালন কাজ শুরুর সময়।
এপিএম টার্মিনালসকে কী কী করতে হবে, তা চুক্তির শর্তে রয়েছে। নির্মাণকাজ শুরুর আগেও সময় ধরে প্রক্রিয়াগত কাজ সেরে নেওয়ার শর্ত রয়েছে। শর্ত না মানলে প্রথমে কারণ দর্শানো নোটিশসহ জরিমানা গুণতে হবে এপিএমটিকে। এরপরও যদি শর্তপূরণ না করে এপিএম টার্মিনালস, তাহলে বন্দর চুক্তি বাতিল করতে পারে। অর্থ্যাৎ এপিএম টার্মিনালসের শর্তভঙ্গের কারণে চুক্তি বাতিল হলে অপারেটর (এপিএমটি) কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের শর্তভঙ্গের কারণে যদি এপিএমটি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় বা চুক্তি বাতিল হয়, তাহলে এপিএমটিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বন্দরকে। এই ক্ষতিপূরণ কত তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে তা এপিএমটির মোট খরচের চেয়ে বেশি বলে জানা গেছে।
চুক্তিতে এপিএম টার্মিনালসের পক্ষ থেকে গ্যারান্টির ধারা রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে এপিএম টার্মিনালসকে তৃতীয় বছর থেকে টার্মিনালটির সক্ষমতার (আট লাখ একক কনটেইনার) ৮০ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো–নামানো করতে হবে। এই হিসাবে এপিএমটিকে তৃতীয় বছর থেকে ৬ লাখ ৪০ হাজার কনটেইনার ওঠানো–নামানো করতে হবে। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি ৬ লাখ ৪০ হাজার কনটেইনারের জন্য কনটেইনারপ্রতি ২১ ডলার করে পরিশোধ করবে। এ ধরনের চুক্তিতে সরকার থেকেও টার্মিনাল অপারেটরকে গ্যারান্টি দেওয়ার ধারা থাকে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ দর–কষাকষি করে তা বাদ দিয়েছে।

এদিকে চুক্তির পর বন্দরের পক্ষ থেকে সেবা মাশুল বাড়ানো হলে তাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানটির যে আয় বাড়বে, তা থেকে শতাংশ হারে বন্দরকে রাজস্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এপিএমটি থেকে এ রাজস্ব কত শতাংশ পাবে বন্দর, তা অবশ্য জানা যায়নি।
চুক্তি অনুযায়ী জেটির সামনে নিজ খরচে খননকাজ করবে এপিএমটি। বন্দরের অপর টার্মিনাল পতেঙ্গা টার্মিনালের চুক্তিতেও সৌদি কোম্পানির খরচে বন্দরে খননকাজ করছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার (হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি) জন্য টার্মিনালের পরিচালন কার্যক্রম নির্ধারিত সময় বন্ধ থাকলে এপিএমটিকে বন্দরের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে চুক্তিতে। তবে এ ক্ষতিপূরণের বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি। আইন পরিবর্তনের কারণে এপিএম টার্মিনালস ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে চুক্তিতে।
কনসেশন চুক্তিতে সাধারণত ‘এসক্রো অ্যাকাউন্ট’–এর বিধান রাখা হয়। ঝুঁকি কমাতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত এ ধরনের নিরাপদ ব্যাংক হিসাব খোলার গুরুত্ব রয়েছে। এ ধরনের হিসাবে টার্মিনালের সব আয় জমা হয়। সেখান থেকে যার যার পাওনা অনুযায়ী পরিশোধ করা হয়। সাধারণত প্রথমে যে ব্যাংক অর্থায়ন করে সে টাকা পায়, এরপর যে প্রতিষ্ঠান ইজারা দিয়েছে তারা পায় এবং সর্বশেষ যারা ইজারা নিয়েছে তারা টাকা পায়। লালদিয়ার চুক্তিতে এই বিধান রাখা হয়নি বলে জানা গেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এপিএম টার্মিনালস বন্দরকে টার্মিনালের রাজস্ব আয়ের শতাংশ হারে দেবে না। কনটেইনারপ্রতি নির্ধারিত ডলার পরিশোধ করবে। এ কারণে এই ধরনের হিসাব খোলার দরকার নেই। পতেঙ্গা টার্মিনালের চুক্তিতেও এ ধরনের হিসাব ছিল না।
লালদিয়ার চরের ৪৯ একর জায়গায় যেখানে টার্মিনাল নির্মাণ হবে, সেখান থেকে কয়েক বছর আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তবে তাঁদের পুনর্বাসন করা হয়নি। সরকার থেকে তারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। চুক্তির মধ্যস্থতাকারী আইএফসি তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য এপিএমটিকে শর্ত দেয়। তাতে চুক্তিতে সামাজিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় তাঁদের পুনর্বাসনের বিধান বাধ্যতামূলক করা রয়েছে। ফলে লালদিয়ার চর থেকে যাঁরা উচ্ছেদ হয়েছেন, তাঁরা সহায়তা পাবেন। এটা কত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তা ১৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৮৪ কোটি টাকার কম নয় বলে জানা গেছে।
এপিএম টার্মিনালস–চট্টগ্রাম বন্দর, কে কী পাবে
চুক্তির পর পরিচালনার বিভিন্ন ধাপে বিনিয়োগ করতে হবে এপিএম টার্মিনালসকে। এ সময়ে বন্দরের কোনো টাকা খরচ হচ্ছে না। এপিএম টার্মিনালসের ঘোষণা অনুযায়ী, তারা ৫৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
চুক্তির পর থেকেই এপিএম টার্মিনালসের বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। যেমন পিপিপি কর্তৃপক্ষ এই চুক্তির জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের হয়ে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার (মধ্যস্থতাকারী) হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) নিয়োগ দিয়েছে। এ জন্য যে খরচ হয়েছে, তা পরিশোধ করেছে এপিএম টার্মিনালস। পিপিপি কর্তৃপক্ষও প্রকল্প উন্নয়নের জন্য এপিএম টার্মিনালস থেকে ফি নিয়েছে। চুক্তি কার্যকরের পর আপফ্রন্ট ফির ৫০ শতাংশ দিতে হবে এপিএম টার্মিনালসকে। এরপর টার্মিনালের নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সংযোজনে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করতে হবে অপারেটরকে।
টার্মিনাল চালু হলে কনটেইনারপ্রতি আয় ভাগাভাগি শুরু হবে। গড়ে আট লাখ একক কনটেইনার ধরে ৩০ বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানো হতে পারে। এতে বন্দরের আয় হতে পারে ৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বাইরে বহির্নোঙরে জাহাজ আসার পর থেকে টার্মিনালে ভেড়ানো পর্যন্ত যত মাশুল আছে, তা পাবে বন্দর। এ খাতে নতুন মাশুলের হিসাবে ফিডার জাহাজপ্রতি ১৯ থেকে ২০ হাজার ডলার আয় হয় বন্দরের। একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানো হলে বছরে অন্তত ৩০০ জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব। তাতে বছরে ৬০ লাখ ডলার হিসাবে ৩০ বছরে আয় হতে পারে সম্ভাব্য ১৮ কোটি ডলার। জাহাজের সংখ্যা কমবেশি হলে আয়ও কমবেশি হতে পারে। আপফ্রন্ট ফিও যুক্ত হবে। তাতে সব মিলিয়ে বন্দরের আয় ৩০ বছরে ৭০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। মেয়াদ শেষে বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার টার্মিনাল অবকাঠামোসহ ফেরত পাবে।
এপিএম টার্মিনালসের বিনিয়োগ উঠে আসতে শুরু করবে বাণিজ্যিক পরিচালন কার্যক্রম শুরুর পর। প্রথম তিন বছরে তারা আয়ের মুখ দেখবে না। জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো বা ওঠানো শুরুর পর তাদের আয় শুরু হবে।
টার্মিনালের প্রধান আয় জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো–নামানো এবং কনটেইনার রাখা বাবদ মাশুল। আইএফসির সমীক্ষা ও বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি হিসাব করে দেখা যায়, এই দুই খাতে প্রতি বক্স কনটেইনারে (২০ ফুট ও ৪০ ফুট কনটেইনার একটি ধরে) সম্ভাব্য মাশুল আয় হতে পারে ১৭৩ দশমিক ৬৬ ডলার। এপিএম টার্মিনালস আট লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানো করবে। বন্দরের হিসাবে আট লাখ একক কনটেইনারে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ চার হাজার ৪২৬ বক্স কনটেইনার (প্রতি বক্স কনটেইনারে ১ দশমিক ৫৮ একক কনটেইনার)। এই হিসাবে এপিএম টার্মিনালসের বছরে সম্ভাব্য আয় হতে পারে ৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, ৩০ বছরে যা দাঁড়াবে প্রায় ২৬৩ কোটি ডলার। এর বাইরে কনটেইনার খুলে পণ্য সরবরাহসহ নানা সেবা ব্যবহার বাবদ আয় করবে টার্মিনালের বিদেশি অপারেটর। এ আয় থেকে বিনিয়োগ ও পরিচালন খরচ ব্যয় করে মুনাফা তুলতে হবে এপিএমটিকে। পরিচালন খরচের মধ্যে এপিএমটির ব্যয়ের একটি অংশ পাবেন বাংলাদেশের যাঁরা কর্মরত থাকবেন তাঁরা।

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটলে দুই পক্ষের আয় নিশ্চিত। বন্দর কোনো বিনিয়োগ না করে আয় পাবে। আর টার্মিনালের বিদেশি অপারেটর বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পাশাপাশি মুনাফা করবে। তাদের পরোক্ষ মুনাফা হবে বেশি। যেমন টার্মিনাল চালু হলে মায়ের্সক লাইনের জাহাজ লালদিয়া টার্মিনালে ভেড়ানোর অগ্রাধিকার পাবে। তাতে জট হলেও তাদের জাহাজ অলস বসে থাকার জন্য দিনে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে না। এ অর্থ সাশ্রয় হবে তাদের। আবার টার্মিনাল থাকায় তাদের ব্যবসা আরও বাড়বে।
দেশের অর্থনীতির কী লাভ, কী ক্ষতি
দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের কনটেইনার পণ্যের ৯৯ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চাহিদার তুলনায় ঘাটতির কারণে কনটেইনার পরিবহন বাড়লে জট নিয়মিত ঘটনা চট্টগ্রাম বন্দরে। লালদিয়া টার্মিনালের আগে, অর্থাৎ ২০৩০ সালের আগে নতুন কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হবে না। চাহিদা বাড়তে থাকলে সামনে জটও বাড়বে। ফলে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের বিকল্প নেই। টার্মিনাল নির্মাণে যত দেরি হবে, ততই বৈদেশিক বাণিজ্যে জটিলতা বাড়বে।
বন্দরের চালু টার্মিনাল, বিশেষ করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে নতুন করে খুব বেশি সক্ষমতা বাড়বে না। তবে লালদিয়া চালু হলে বছরে আট লাখ একক কনটেইনার পরিবহনের সক্ষমতা যুক্ত হবে, যা কনটেইনার পরিবহনের তীব্র চাহিদার যে ঘাটতি রয়েছে, তা মেটাতে পারে।
কনটেইনারে মূলত রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি হয়। এসব পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম যত দ্রুত হবে, তত সুবিধা পাবেন রপ্তানিকারকেরা। শুধু রপ্তানির উদাহরণ দেওয়া যাক। এনবিআরের হিসাবে, গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২২৬ কোটি ডলারের পণ্য। এ পণ্যের এক–চতুর্থাংশ রপ্তানি হবে লালদিয়া টার্মিনাল ব্যবহার করে, অর্থাৎ আয়ের চেয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যকে গতিশীল করলে তা হবে সবচেয়ে বড় সুবিধা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালস বিশ্বখ্যাত। এ কাজে তাদের দক্ষতা আছে। ফলে তারা দক্ষভাবে টার্মিনাল চালালে পণ্য রপ্তানিতে সময় কমবে। চুক্তিতে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু না থাকলে এবং ব্যবসার খরচ না বাড়লে এ চুক্তিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।’
ডিপো থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে তা বিদেশি ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিতে ব্যবসায়িক বিষয় ছাড়া যেগুলো প্রকাশ করতে বাধা নেই, সেগুলো প্রকাশ করা উচিত। তাহলে চুক্তি নিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর হবে।
খায়রুল আলম বলেন, চুক্তি অনুযায়ী এপিএম টার্মিনালস বিনিয়োগ করে কনটেইনারে আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহনের সুবিধা তৈরি করবে। তাদের জাহাজ থেকে শুরু করে কনটেইনার ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, অর্থাৎ সরবরাহ লাইনের সব সেবা আছে। লালদিয়ার বড় জাহাজ ভেড়ানো যাবে। তাতে মায়ের্সক যদি সরাসরি ইউরোপ–আমেরিকার সঙ্গে কনটেইনার জাহাজ সেবা চালু করে, তাহলে যে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ, তা টার্মিনাল থেকে আয়ের হিসাবের চেয়েও বেশি।

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাম্প ট্যারিফ, আসন্ন এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) উত্তরণসহ বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগের চুক্তিগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। বিনিয়োগের শর্ত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা জনসাধারণ ও দেশি বিশেষজ্ঞদের জানাতে হবে।
আবার কনটেইনার টার্মিনালে বাংলাদেশের যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণে জোর দেওয়ার পাশাপাশি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রযুক্তি হস্তান্তর শেষে যাতে দেশি অপারেটররা টার্মিনাল পরিচালনা করতে পারে, সে বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।