কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সরাসরি বড় পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। এখনো কোনো নির্বাচন আয়োজন না করা বর্তমান ইসিকে একই দিনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট করতে হবে। একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম।
ইসি আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সেরে রাখার কথা জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার একই দিনে গণভোট আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নিয়ে বর্তমান কমিশন উপকরণসহ (লজিস্টিকস) নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সঠিক সময়ে ভোট গ্রহণ শেষ করাও হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নিজেও সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট নেওয়াকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন। তবে কমিশনের সূত্র বলছে, চ্যালেঞ্জিং হলেও কঠিন নয়। সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। গণভোটের জন্য শুধু ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটকেন্দ্র কিছু বাড়াতে হবে। সময়ের মধ্যে ভোট শেষ করাও হবে চ্যালেঞ্জ। সময়মতো ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে দুই ভোট গ্রহণ শেষ করা যায় কি না, তা বোঝার জন্য ২৯ নভেম্বর মক (মহড়া) ভোটের আয়োজন করবে ইসি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেয়। এই কমিশনের অধীনে এখনো কোনো পর্যায়ের নির্বাচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ার পর ইসি ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে ওই প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন বলে দাবি ইসির। দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এবার ভোটার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ভোট নেওয়া হবে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে। ইসি আগামী মাসের (ডিসেম্বর) প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে ১৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার এক সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠি দিয়ে ইসিকে গণভোট আয়োজনের সরকারের নির্দেশনার বিষয়টি জানায়।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করতে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন ভোটের দিন গণভোট নেওয়াকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন। একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করার ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়ে বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী কোনো নির্বাচন কমিশনকে পড়তে হয়নি। এতটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি, যা বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এবারের ভোটে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) নির্মিত কনটেন্টকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তিনি।
অবশ্য সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনে বাড়তি প্রস্তুতির বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। এখন গণভোটের জন্য শুধু বাড়তি ব্যালট পেপার লাগবে। সেই ব্যালট ছাপানোর কাগজ সংগ্রহ করেছি। নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই।’ তিনি জানান, একই সঙ্গে দুটি ভোট আয়োজন করায় কমিশনের কর্মযজ্ঞ বেড়েছে। মূল চ্যালেঞ্জ নির্ধারিত সময়ে ভোট শেষ করা। এ ছাড়া শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ। এ জন্য তাঁরা ২৯ নভেম্বর একটি মক ভোটের আয়োজন করবেন। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বুথ বাড়ানো হবে কি না বা করণীয় কী হবে, সেসব বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
ইসি সূত্র জানায়, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের আশপাশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই মক ভোট করা হবে। মূল ভোটে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন, মক ভোটেও তাঁদের রাখা হবে। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা বুথ থাকবে। বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভোটকক্ষে কী ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, তাও মক ভোটে পরীক্ষা করা হবে। নির্বাচন কমিশনাররা সেখানে গিয়ে ভোট গ্রহণ, ভোট দিতে কত সময় লাগছে, দুটি ভোট দিতে কোনো জটিলতা হচ্ছে কি না, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মক ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই ভোট করা হবে। মক ভোটে নারী ভোটকক্ষে ৫০০ এবং পুরুষ ভোটকক্ষে ৬০০ ভোটার রাখার চিন্তা করা হচ্ছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, সংসদ নির্বাচনের বড় প্রস্তুতির মধ্যে ছবিসহ ভোটার তালিকা, নির্বাচনী মালামাল সংগ্রহ, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য অ্যাপ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ চলছে। গণভোটের জন্য বিজি প্রেস থেকে বাড়তি আলাদা ব্যালট ছাপাতে হবে।
একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হবে বলে ইসিকে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্সেরও ব্যবস্থা করতে হবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে ইসির সংগ্রহে ৩ লাখ ৪০ হাজারের মতো ব্যালট বাক্স রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে সাধারণত ২ লাখ ৮৮ হাজারের মতো ব্যালট বাক্স লাগে। সে হিসেবে ৫০ হাজারের বেশি ব্যালট বাক্স অতিরিক্ত আছে। বুথ ৪০ থেকে ৪২ হাজার বাড়ালেও প্রভাব পড়বে না।
সূত্র জানায়, একটি ব্যালট বাক্সে ১৫০০-এর মতো ব্যালট পেপার রাখা যায়। সংসদ নির্বাচনের ব্যালট হবে আগের মতোই সাদা-কালো। গণভোটের জন্য সবুজ বা গোলাপি রঙের ব্যালট ছাপানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে বিধিমালা ঠিক হলে এটি চূড়ান্ত করবে কমিশন। গতকাল সোমবার ডাক বিভাগের সঙ্গে পোস্টাল ভোট নিয়ে বৈঠক করেছে ইসি। একই সিরিয়াল নম্বরের সংসদ ও গণভোটের ব্যালট পেপার যেন একসঙ্গে থাকে ডাক বিভাগকে সেই নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন।
সূত্র জানায়, প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটের প্রাপক জেলা প্রশাসককে করা হবে না। যিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন তাঁর দপ্তরে এই ব্যালট আসবে। যেসব জেলায় বেশি সংসদীয় আসন রয়েছে, সেখানে একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা করছে কমিশন।
তফসিল ঘোষণার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ২৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রধানদের সঙ্গে এবং ৩০ নভেম্বর সচিব ও বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে ইসি। ওই বৈঠকে ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল তৈরিসহ সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেবে ইসি।
একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রথম চ্যালেঞ্জ লজিস্টিক্যাল। দুই ধরনের ভোটের জন্য দুটি ব্যালট বাক্স দিতে হবে, দুই সেট ব্যালট পেপার ছাপাতে হবে। ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের তালিকাও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সময়মতো ভোটগ্রহণ শেষ করাও ইসির জন্য চ্যালেঞ্জের হবে।
আব্দুল আলীম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দিনে গণভোটকে কতটা প্রাধান্য দেবে, এটাও ইসির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। গণভোটের জন্য কমিশনের বর্তমান রোডম্যাপ পাল্টে নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। পাইলটিং না করে প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রেও কমিশনকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে।