প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সমন্বিত ব্যবস্থা ও মনিটরিং কার্যক্রমের জন্য মাস্টার প্ল্যানের খসড়া প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সোমবার (২৪ নভেম্বর) এ খসড়া প্রকাশ করে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে সবার কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। এতে বছরে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ জন পর্যটক যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সমন্বিত ব্যবস্থা ও মনিটরিং কার্যক্রমের জন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপের মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তুতকৃত খসড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টালে www.moefcc.gov.bd সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে নোটিশ বোর্ডে আপলোড করা হয়েছে।
উল্লিখিত খসড়া মাস্টার প্ল্যানের ওপর আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে [email protected] ই-মেইলে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থা, জনসাধারণ ও অংশীজনদের লিখিত মতামত প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
খসড়ার সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তাঁর জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে প্রবাল ও সামুদ্রিক কচ্ছপের জন্য একটি অনন্য স্থান। এটি কেবল প্রবাল বৈচিত্র্যের কেন্দ্রই নয়, এটি পরিযায়ী পাখিদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। এটি পরিযায়ী পাখিদের শীতকালীন আশ্রয়স্থল এবং বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত।
ম্যানগ্রোভ, ঝোপঝাড় এবং বালিয়াড়ি সমৃদ্ধ ২৬৯ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ১৯৪ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এই দ্বীপের প্রতিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। ৬৬ প্রজাতির প্রবালের উপস্থিতি এ দ্বীপকে একটি অনন্য হটস্পট হিসেবেও পরিচিতি দিয়েছে। গত দুই দশকে, অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক আগমনের কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রতিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
পিক সিজনে প্রতিদিন ৩ থেকে ৭ হাজার পর্যটকের আগমন দ্বীপের সীমিত ধারণক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যেমন-পর্যটকদের অতিরিক্ত উপস্থিতি বর্জ্য এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা হোটেল, এবং রেস্তোরাঁ দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যার ফলে কৃষি জমি এবং সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
এ পটভূমিতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে, পরিবেশ অধিদপ্তর একটি বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদী ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রস্তুত করেছে। এ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আগামী ১০ বছরে দ্বীপের পরিবেশের সুরক্ষা এবং একই সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। এতে কেবল পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক টেকসই উন্নয়নের ওপরও সমানভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-
পর্যটন নিয়ন্ত্রণ: পরিবেশের ক্ষতি রোধ করতে, প্রতিদিন পর্যটকের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৯০০ জনের মধ্যে সীমিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি দ্বীপের প্রতিবেশের পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করবে।
নির্দিষ্ট পর্যটন এলাকা: পর্যটকদের কার্যক্রম, সাধারণ ব্যবহার অঞ্চলের (General Use Zone) সৈকত সলগ্ন ৪.১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করবে।
৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র: এই মাস্টার প্ল্যান মোট ৯টি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ২৬টি প্রোগ্রামের মাধ্যমে কাজ করবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা, প্রবাল ও কচ্ছপ সংরক্ষণ, বর্জ্য ও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয়দের জীবিকা উন্নয়ন। এই সমন্বিত পদক্ষেপগুলো দ্বীপের প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সামগ্রিকভাবে সমাধান করবে বলে আশা করা যায়।
মাস্টার প্ল্যানটি স্বল্প (১-৩ বছর), মধ্যম (১-৫ বছর) এবং দীর্ঘ (১-১০ বছর) মেয়াদী ৩ ধরণের কার্যক্রম নিয়ে সাজানো হয়েছে। এর সফল বাস্তবায়নের জন্য মোট ৫৪৭.৯ মিলিয়ন টাকার প্রয়োজন হবে। এই তহবিল প্রধানত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই পর্যটনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকেও উৎসাহিত করা হবে। পরিকল্পনার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি বিশেষ তথ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম (এমআইএস) ব্যবহার করা হবে।
এটি ২৬টি উদ্যোগের নিয়মিত অগ্রগতি রেকর্ড করবে এবং উদ্যোগগুলি যাতে জাতীয় কৌশলগত লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরচালিত হয় তা নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই মাস্টার প্ল্যান সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একটি আদর্শ এবং টেকসই পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথ নির্দেশনা দেবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর সফল বাস্তবায়ন শুধু দ্বীপের পরিবেশকে রক্ষা করবে তা নয়, বরং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মানসম্মত জীবনব্যবস্থা ও দ্বীপটির প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। মাস্টার প্ল্যানের খসড়ার বিস্তারিত দেখতে এখানে ক্লিক করুন।