Image description

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের পর আবারো আলোচনায় এসেছে রাজধানী ঢাকার ভঙ্গুর অবকাঠামোর চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু এ শহর ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনিয়ম বিশেষ করে ভবনের নকশা অনুমোদন ও ইন্সপেকশন প্রক্রিয়ায় ঘুস, নিয়ম ভেঙে ভবন উঠতে দেয়া সে ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। যদিও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ভবন নির্মাণের অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও গাফিলতির জন্য শাস্তির আওতায় না এনে শুধু ভবন মালিকদেরই শাস্তি দিচ্ছে সংস্থাটি।

গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের লক্ষ্যে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, মুগদা ও বাড্ডার আলাতুন্নেসা স্কুল ও কলেজ সরজমিনে পরিদর্শন করেছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম। এ সময় আরমানিটোলার রেলিং ভেঙে তিনজন নিহত হওয়া ভবনটি পরিদর্শন করেন রাজউক চেয়ারম্যান। তাৎক্ষণিকভাবে ভবনের নকশা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় ভবনটির মালিক পক্ষের ওপর অসন্তুষ্ট হন রাজউক চেয়ারম্যান। সাতদিনের মধ্যে বিনা ব্যর্থতায় রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর নকশা দাখিলের নির্দেশ দেন। এছাড়া ভবনটির ঝুঁকিপূর্ণ অংশ অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর মুগদা এলাকায় পার্শ্ববর্তী ভবনের ওপর হেলে পড়া একটি ভবন পরিদর্শন করেন রাজউক চেয়ারম্যান। পরিদর্শনকালে সার্বিক দিক বিবেচনায় ঝুঁকি চিহ্নিত করে ভবন দুটির নিচতলায় থাকা দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। সাতদিনের ভেতর ভবনগুলোর নকশা দাখিলের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

এর আগে গত বছরের মার্চে বেইলি রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনার পর রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট চালানোর অনুমতি ছিল না। এরপর ভবনটির মালিকসহ তিন রেস্টুরেন্ট মালিকদের নামে হত্যা চেষ্টা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে রমনা থানায় মামলা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর ভবনসংক্রান্ত যেকোনো অনিয়মের দায়দায়িত্ব রাজউকের ওপর বর্তায়। কিন্তু যখনই কোনো দুর্যোগ ঘটে রাজউক ভবনটির অনুমোদন নেই বা অবৈধ ভবন বলে দায় এড়িয়ে যায়। এতে করে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব অবহেলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন।

ভবন নির্মাণসংক্রান্ত বিভিন্ন অংশীজন বলছেন, ঢাকার আজকের এ পরিস্থিতির পেছনে রাজউকের ব্যর্থতাই অন্যতম কারণ। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনিয়মের কারণে সেভাবে শাস্তির আওতায় না আসায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। রাজউকে বড় ধরনের অনিয়ম হয় ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়ির নকশা অনুমোদন এমন প্রক্রিয়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মোটা অংকের ঘুস ছাড়া এ কাজ প্রায় অসম্ভব। সেবাপ্রত্যাশীরা বাড়ি নির্মাণের সময় নকশা অনুমোদনের জন্য ঘুসের টাকা আলাদা রেখে তারপর কাজ শুরু করেন। বাড়ি ও প্রজেক্টভেদে প্ল্যান পাস ৫ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুস দিতে হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজউকের ঘুস-দুর্নীতি নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ফলাফলে দেখা গেছে, ইমারতের নকশা অনুমোদনের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তাদের ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুস দিতে হয়।

রাজউকের বড় দুর্নীতি হয় নকশা অনুমোদনসংক্রান্ত কাজগুলোর ক্ষেত্রে। এখানেই সবচেয়ে বেশি জিম্মি হয়ে পড়েন সেবাপ্রত্যাশীরা। এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধের জন্য ২০২২ সালে ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিএসপি) নামে অনলাইন সেবা চালু করেছিল রাজউক। বাড়ির নকশা অনুমোদনে ইচ্ছুক ব্যক্তি সাইটে জমির পরচা, খাজনার রসিদ, এনআইডি ইত্যাদি দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ছাড়পত্র নিতে হয়। এ বিষয়ে রাজউকের একাধিক সূত্র বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, ওয়েবসাইট শুধু নামেই। সব কাজ টেবিলে টেবিলেই হয়।

ঘুস-দুর্নীতি ছাড়া রাজউকে প্লান পাস হয় না বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) বর্তমান সভাপতি স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি রাজউক যেন তার দুর্নীতিগ্রস্ত অথরাইজড অফিসারের ইমারত পরিদর্শকদের নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সংখ্যা প্রকাশ করে। এটা চাইলেই সম্ভব। কোনো ভবন অথরাইজড অফিসারের সাইন ছাড়া, ইমারত পরিদর্শকের সাইন ছাড়া নির্মাণ হয় না। তাহলে যে ভবন হেলে পড়ল, আগুন লাগল, সেটায় যে কর্মকর্তার সই আছে তাকে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনলেই কিন্তু অন্যরা সোজা হয়ে যায়। কিন্তু রাজউক সেটা করে না। তারা শুধু ভবন মালিককে জরিমানা করে। ভবন ভেঙে দেয়। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বে অবহেলার কোনো শাস্তি তারা দেয় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো আমরা ভবনের অনুমোদনের কাগজ সাবমিট করলে মাসের পর মাস চলে যায় অনুমোদন পেতে, আর দালাল ধরলে সাতদিনেই অনুমোদন মেলে। এ নৈরাজ্য রাজউককে বন্ধ করতেই হবে। রাজউকের দুর্নীতিগ্রস্ত অথরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শকদের তালিকা প্রকাশ করে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।’

কোনো ভবনের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটা মানে রাজউকের সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসার, পরিদর্শক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এ অপরাধে তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের (ইউআরপি) অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কয়েক পক্ষ কাজ করে। মালিক পক্ষ, প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও রাজউক। মালিক নিজে যেমন আইন ব্যত্যয় করে অন্যায় করেছেন, সেটি না থামিয়ে রাজউকের সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসার, ইমারত পরিদর্শকও অন্যায় করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি শাস্তি কেবল ভবন মালিকই পায়। তাদের জরিমানা করা হয়, ভবন ভেঙে দেয়। কিন্তু যে অথরাইজড অফিসার নিজের দায়িত্ব অবহেলা করেন, মোটা অংকের ঘুস খেয়ে বসে আছেন, তাকে কিন্তু শাস্তি দেয়া হয় না। ঘুসটা হয়তো সবসময় প্রমাণিত নয়। কিন্তু দায়িত্ব অবহেলা তো এড়ানোর সুযোগ নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘অথরাইজড অফিসার বেতনই নেন ভবন যেন সঠিকভাবে হয় সেটা দেখার জন্য। তাহলে তার জোনে যে ভবনগুলো নিয়ম-বহির্ভূতভাবে গড়ে উঠেছে সেগুলোর দায় তাকে নিতে হবে না?’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে রাজধানীর বড় অংশই গড়ে উঠেছে বিপজ্জনক নগরী হিসেবে। বিশেষ করে পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, কেরানীগঞ্জ, রুহিতপুর, ডেমরা, চিটাগং রোড, রূপগঞ্জের মতো এলাকার ভবন মালিকরা রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই ভবন তুলে ফেলছেন। বেশির ভাগ ভবন মালিকই অথরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শকদের যোগসাজশে এসব করছেন বলে খাতসংশ্লিষ্টরা অভিযোগ জানিয়েছেন।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউক চাইলে ঢাকার কোনো ভবনে নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত না। ভবনের নকশা অনুমোদনের সময়ই সংশ্লিষ্ট জোনের কর্মকর্তারা ঘুস খেয়ে বসে থাকেন। তারপর ভবন নির্মাণকালে ইন্সপেক্টররা ঘুস খেয়ে চুপ থাকেন। যখন বিল্ডিং নির্মাণ শেষ হয়ে যায় তখন আবার টাকার বিনিময়ে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেয়া হয়। আবার ভবনে যখন আগুন লাগে কিংবা ধসে পড়ে তখন বলা হয়, ভবনের নকশার ব্যত্যয় হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান ভ্যারিয়েডস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজউক কাগজে-কলমে নিট অ্যান্ড ক্লিন প্রতিষ্ঠান। তারা আজ পর্যন্ত নিয়ম ভেঙে কোনো ভবনের অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু ভবন মালিকদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি থাকে। সঠিক নকশা দেয়া হলেও ভবন যেভাবে খুশি বানানোর ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। লেনদেন ঠিক থাকলে কেউ কিছু বলে না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মূল নকশা দেখিয়ে রাজউকের কর্মকর্তারা পার পেয়ে যান।’

তিনি বলেন, ‘কোনো ভবন মালিক বা ডেভেলপার যখন নিশ্চিতভাবে জানবেন, আইনের ব্যত্যয় করলে যেকোনো মূল্যেই তার ভবন ভেঙে ফেলা হবে, তাহলে কে কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করে নিয়মবহির্ভূত ভবন বানাবেন। আসলে সবাই জানে, রাজউকে পয়সা দিয়ে পার পাওয়া যায়। কোনো রকম ভবন দাঁড়িয়ে গেলে রাজউক আর কিছু করতে পারে না। দিনশেষে রাজউক কর্মকর্তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হন, সাধারণ মানুষ ভূমিকম্পে দেয়াল দসে, আগুনে পুড়ে মারা যান।’

রাজউকের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করা সম্ভব ছিল উল্লেখ করে এ আবাসন উদ্যোক্তা বলেন, ‘যখন কোনো ভবনের নকশা মানা হয় না তখন যদি রাজউক গিয়ে ভবনের কলাম ভেঙে দিত তাহলে কারো সাহসই হতো নকশার ব্যত্যয় করার। তারা গিয়ে বারান্দা ভেঙে দেয়। গিয়ে গেটে একটু খোঁচা দিয়ে আসে। আর বলে অফিসে গিয়ে কথা বলবেন। তখন ভবন মালিক বুঝে নেয় কেন দেখা করতে বলা হয়েছে।’

তবে ভবনের নিয়ম ব্যত্যয় করার ক্ষেত্রে মালিকই মূল দোষী বলে মনে করেন রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজউক কাউকে প্ল্যান করে দেয় না। বাড়িওয়ালারাই ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট দিয়ে বাড়ির প্ল্যান করে রাজউকে জমা দেন এই শর্তে যে রাজউকের নিয়ম মোতাবেক করবেন। পরে তারা সেটা না মানলে জরিমানা কিংবা শাস্তি দিতে হলে সেই বাড়িওয়ালাদেরই দেয়া উচিত। এর দায়ভার রাজউকের না।’

যদিও ভিন্ন কথা বলেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সচিব মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি ও সুশাসন না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। যেসব অথরাইজড অফিসার এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে, আমরা তাদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এসব অথরাইজড অফিসারকে শাস্তির আওতায় আনব।’