Image description

অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহারে মৃত্যুঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের  (আইইডিসিআর) পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ৪১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অন্য সব রোগীর ক্ষেত্রে এই হার ৭ শতাংশ।   

গতকাল সোমবার দুপুরে ন্যাশনাল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স-এএমআর সার্ভেইলেন্স ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটির সম্মেলনকেন্দ্রে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীব প্যান ড্রাগ রেজিট্যান্স (পিডিআর) সব রোগীর ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ এবং  আইসিইউর রোগীদের ক্ষেত্রে পিডিআরের উপস্থিতি ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ কাজ করছে না।

পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন হাবিব জানান, আইসিইউর পাঁচটি প্যাথোজেনের জন্য ৭১টি অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষা করা হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশের বেশি সংবেদনশীলতা রয়েছে মাত্র পাঁচটি ওষুধের, একটির সংবেদনশীলতা ৬০-৮০ শতাংশের মধ্যে। বাকি সব ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা ৬০ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ বেশির ভাগ ওষুধের কার্যকারিতা ৪০ শতাংশের কম।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, এই পর্যবেক্ষণ থেকে যে বার্তা পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক।

জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কমানো যায়নি। এমনকি সেটি বন্ধ করাও যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা জরুরি। অর্থাৎ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবে না।

ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

হাসপাতালের ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী নেওয়াই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় বাধা। ৫০ শয্যার হাসপাতালে যদি ৫০০ রোগী নিতে হয়, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বা সংক্রমণ প্রতিরোধের ন্যূনতম শর্তই বজায় রাখা সম্ভব নয়।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সব নমুনা থেকে মোট ১২৩টি অণুজীব ও ওষুধের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৩৮টি ওষুধের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা বেড়েছে, ৭৯টির ক্ষেত্রে কমেছে এবং ছয়টি অপরিবর্তিত রয়েছে। 

২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত এই পর্যবেক্ষণ পরিচালিত হয়। এই সময়ে ১৩টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং আটটি প্রাইভেট হাসপাতালের বিভিন্ন শাখা থেকে ৯৬ হাজার ৪৭৭ জন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ওষুধগুলো মূত্রনালির সংক্রমণ, সেপ্টিসেমিয়া, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং ক্ষত সংক্রমণের মতো রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলোর বিরুদ্ধে পরীক্ষা করা হয়।

অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে মূলত তিনটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এগুলো হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের সংক্রমণের জন্য অ্যাক্সেস গ্রুপ, উচ্চ সহনশীল ব্যাকটেরিয়ার জন্য ওয়াচ গ্রুপ এবং সব বিকল্প ব্যর্থ হলে রিজার্ভ গ্রুপ

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উচ্চ সহনশীল ব্যাকটেরিয়ার জন্য ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। যা আগে ছিল ৭৭ শতাংশ, বর্তমানে ৯০.৯ শতাংশ।

ড. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, হাসপাতালে আসার আগেই বেশির ভাগ রোগী ওয়াচ গ্রুপের ওষুধ সেবন করছে। এতে চিকিৎসকরা গুরুতর পরিস্থিতিতে রোগীকে দেওয়ার মতো ওষুধ পাচ্ছে না। তখন রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে যে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, এতে রোগী বেঁচে গেলেও বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার ছয় কারণ :  ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং পরজীবীর মতো অণুজীবকে ধ্বংস করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতাকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বলা হয়।

জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার পেছনে ছয়টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রেসক্রিপশন, কোর্স সম্পন্ন না করা, পশুপাখির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দুর্বল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা,  স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির অভাব,  নতুন করে অ্যান্টিবায়োটিক না আসা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় অনেক রোগী হাসপাতালে নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগের তুলনায় হাসপাতালে সংক্রমণ কিছুটা কমেছে, তবু প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. শেখ ছাইদুল হক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করা কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এটি খুবই জটিল কাজ। প্রশাসনিক তদারকি আরো বাড়াতে হবে এবং সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা মিলেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।