Image description
নরসিংদীর সাবেক এসপির গুরুপাপে লঘুদণ্ড

বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার  মো. আব্দুল হান্নান নরসিংদীতে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে পদায়ন পেতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। তা তিনি দিয়েছিলেন ২০২৩ সালে। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছরের নভেম্বরে তিনি নরসিংদীর এসপি হন। এর পরই ক্ষমতার প্রভাবে ঘুষের টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা ফেরতও নেন তিনি।

বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সেই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে লঘুদণ্ড তিরস্কার দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ঘুষের মতো একটি ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এমন নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তিরস্কার দণ্ড দেওয়ায় তোলপাড় ও কানাঘুষা চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ প্রশাসনে।

চাউর আছে, মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তির এক নিকটাত্মীয়ের সমঝোতায় এ লঘু শাস্তি হয়েছে। এ জন্য বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও এমন দণ্ড তাঁকে তিরস্কৃত নয়, পুরস্কৃত করা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পদায়ন নেওয়া ফৌজদারি অপরাধ।

এত টাকা ওই কর্মকর্তার আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মানে এ টাকা দুর্নীতির। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা করা উচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ প্রশাসনের। ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহিতা দুজনকেই আইনের আওতায় আনতে হবে।

গত রবিবার সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির সই করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-১ শাখা থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সম্প্রতি গঠিত বিভাগীয় তদনন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৩ সালে নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে পদায়নের উদ্দেশ্যে তিনি কথিত রবিউল মুন্সী নামের এক ব্যক্তিকে ৫০ লাখ টাকা দেন।

তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এ পদায়ন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ৯ নভেম্বর নরসিংদীতে এসপি হিসেবে যোগদানের পর তিনি এবং তাঁর অধীন ডিবি ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক এস এম কামরুজ্জামান অনুমতি ছাড়া ঢাকায় গিয়ে মণিপুরিপাড়ায় রবিউল মুন্সীর অফিস থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেন। অবশিষ্ট ৪৫ লাখ টাকা ফেরতের জন্য তাদের উপস্থিতিতেই একটি স্বহস্তে লিখিত দলিল গ্রহণ করা হয়। সাংবাদিক নেছারুল হক খোকনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সময় পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান বদলিসংক্রান্ত বিষয় এবং ব্যক্তিগত কাজে অধস্তন পুলিশ সদস্য ব্যবহারের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে কথোপকথনটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারির পর পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান লিখিত জবাব দাখিল করেন এবং ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করেন। গত ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত শুনানিতে উভয়পক্ষের বক্তব্য, নথিপত্র ও অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তদন্ত কর্মকর্তা ও শুনানি কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তাঁকে তিরস্কার দণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের বিতর্কিত অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর। সম্প্রতি তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের কাউকে কাউকে পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করারও পাঁয়তারা চলছে। এ জন্য বড় ধরনের লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে বলে চাউর আছে। তবে সরকারের শীর্ষমহলকে বোঝানো হয়েছিল যে তাঁরা ওএসডি থাকলে বা ঢাকায় থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। নির্বাচন বানচাল করতে পারে।

একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সংস্কার করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই মন্ত্রণালয়ে। এখনো পুলিশের বদলি, পদায়নে বাণিজ্য চলছে; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেট বেড়েছে। শুধু পুলিশ নয়, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও কারাগারেও বদলি, পদায়ন বাণিজ্য চলছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, মানুষ কত গল্প বানায়! এটা ৫০ লাখ টাকার ঘুষের বিষয় নয়, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ব্যবসাসংক্রান্ত লেনদেনের বিষয়। আমার বিবেক অনুযায়ী লঘুদণ্ড দিয়েছি। এখানে ঘুষের কোনো বিষয় নেই। আর এসব কাজে আমার কোনো আত্মীয়ও নেই। তারা এসব থেকে অনেক দূরে থাকে।

ব্যবসার বিষয় হলে আপনার সই করা প্রজ্ঞাপনে ঘুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে কেনএ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ভেতরের গল্প হয়তো তারা জানে না। এটা হয়তো আমার অফিসারদের ভুল হতে পারে।

প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসন বিষয়ক বহু গ্রন্থপ্রণেতা মো. ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এ অপরাধে দুদকে মামলা হওয়ার কথা। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী এ শাস্তি হতেই পারে। এটা আইনের গলদ। কিন্তু আমাদের সমাজে ঘুষকে বড় অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি তিরস্কার হলে তা সমাজে ঘুষকে উসকে দেওয়ারই শামিল।