Image description
» দেশে প্রথমবার একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হবে । » নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করার পর গণভোটের কর্মযজ্ঞ । » সব বিষয় পর্যবেক্ষণে আগামী শনিবার ভোটের মহড়া করবে ইসি ।

কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সরাসরি বড় পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে ( ইসি ) । এখনো কোনো নির্বাচন আয়োজন না করা বর্তমান ইসিকে একই দিনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট করতে হবে । একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম । ইসি আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সেরে রাখার কথা জানিয়েছে । অন্তর্বর্তী সরকার একই দিনে গণভোট আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে । নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন , একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নিয়ে বর্তমান কমিশন উপকরণসহ ( লজিস্টিকস ) নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে । সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সঠিক সময়ে ভোট গ্রহণ শেষ করাও হবে বড় চ্যালেঞ্জ ।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ( সিইসি ) এ এম এম নাসির উদ্দিন নিজেও সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট নেওয়াকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন । তবে কমিশনের সূত্র বলছে , চ্যালেঞ্জিং হলেও কঠিন নয় । সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে । গণভোটের জন্য শুধু ব্যালট পেপার , ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে । ভোটকেন্দ্র কিছু বাড়াতে হবে । সময়ের মধ্যে ভোট শেষ করাও হবে চ্যালেঞ্জ । সময়মতো ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে দুই ভোট গ্রহণ শেষ করা যায় কি না , তা বোঝার জন্য ২৯ নভেম্বর মক মহড়া ) ভোটের আয়োজন করবে ইসি ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেয় । এই কমিশনের অধীনে এখনো কোনো পর্যায়ের নির্বাচন হয়নি । অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ার পর ইসি ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে । এরই মধ্যে ওই প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন বলে দাবি ইসির । দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এবার ভোটার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । এই ভোট নেওয়া হবে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে । ইসি আগামী মাসের ( ডিসেম্বর ) প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে । এদিকে ১৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন । এই ঘোষণার এক সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠি দিয়ে ইসিকে গণভোট আয়োজনের নির্দেশনার বিষয়টি জানায় ।

ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান , একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করতে এ - সংক্রান্ত অধ্যাদেশের অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা । সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন ভোটের দিন গণভোট নেওয়াকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন । একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করার ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়ে বলেছেন , এমন পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী কোনো নির্বাচন কমিশনকে পড়তে হয়নি । এতটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি , যা বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে । এবারের ভোটে এআই ( কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ) নির্মিত কনটেন্টকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তিনি ।

অবশ্য সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনে বাড়তি প্রস্তুতির বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে । এখন গণভোটের জন্য শুধু বাড়তি ব্যালট পেপার লাগবে । সেই ব্যালট ছাপানোর কাগজ সংগ্রহ করেছি । নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই । ' তিনি জানান , একই সঙ্গে দুটি ভোট আয়োজন করায় কমিশনের কর্মযজ্ঞ বেড়েছে । মূল চ্যালেঞ্জ নির্ধারিত সময়ে ভোট শেষ করা । এ ছাড়া শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ । এ জন্য তাঁরা ২৯ নভেম্বর একটি মক ভোটের আয়োজন করবেন । এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বুথ বাড়ানো হবে কি না বা করণীয় কী হবে , সেসব বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে । 

ইসি সূত্র জানায় , রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের আশপাশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই মক ভোট করা হবে । মূল ভোটে যেসব কর্মকর্তা - কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন , মক ভোটেও তাঁদের রাখা হবে । নারী - পুরুষের জন্য আলাদা বুথ থাকবে । বয়স্ক , অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভোটকক্ষে কী ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে , তাও মক ভোটে পরীক্ষা করা হবে । নির্বাচন কমিশনাররা সেখানে গিয়ে ভোট গ্রহণ , ভোট দিতে কত সময় লাগছে , দুটি ভোট দিতে কোনো জটিলতা হচ্ছে কি না , এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন ।

ইসির কর্মকর্তারা জানান , সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত মক ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই ভোট করা হবে । মক ভোটে নারী ভোটকক্ষে ৫০০ এবং পুরুষ ভোটকক্ষে ৬০০ ভোটার রাখার চিন্তা করা হচ্ছে । ইসির কর্মকর্তারা জানান , সংসদ নির্বাচনের বড় প্রস্তুতির মধ্যে ছবিসহ ভোটার তালিকা , নির্বাচনী মালামাল সংগ্রহ , সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ , রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন , দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন , প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য অ্যাপ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে । নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ চলছে । গণভোটের জন্য বিজি প্রেস থেকে বাড়তি আলাদা ব্যালট ছাপাতে হবে । একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হবে বলে ইসিকে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্সেরও ব্যবস্থা করতে হবে ।

সূত্র জানায় , বর্তমানে ইসির সংগ্রহে ৩ লাখ ৪০ হাজারের মতো ব্যালট বাক্স রয়েছে । সংসদ নির্বাচনে সাধারণত ২ লাখ ৮৮ হাজারের মতো ব্যালট বাক্স লাগে । সে হিসেবে ৫০ হাজারের বেশি ব্যালট বাক্স অতিরিক্ত আছে । বুথ ৪০ থেকে ৪২ হাজার বাড়ালেও প্রভাব পড়বে না ।

সূত্র জানায়, একটি ব্যালট বাক্সে ১৫০০ - এর মতো ব্যালট পেপার রাখা যায় । সংসদ নির্বাচনের ব্যালট হবে আগের মতোই সাদা - কালো । গণভোটের জন্য সবুজ বা গোলাপি রঙের ব্যালট ছাপানোর চিন্তা করা হচ্ছে । তবে বিধিমালা ঠিক হলে এটি চূড়ান্ত করবে কমিশন । গতকাল সোমবার ডাক বিভাগের সঙ্গে পোস্টাল ভোট নিয়ে বৈঠক করেছে ইসি । একই সিরিয়াল নম্বরের সংসদ ও গণভোটের ব্যালট পেপার যেন একসঙ্গে থাকে ডাক বিভাগকে সেই নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন । সূত্র জানায় , প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটের প্রাপক জেলা প্রশাসককে করা হবে না । যিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন তাঁর দপ্তরে এই ব্যালট আসবে । যেসব জেলায় বেশি সংসদীয় আসন রয়েছে , সেখানে একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা করছে কমিশন । তফসিল ঘোষণার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ২৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রধানদের সঙ্গে এবং ৩০ নভেম্বর সচিব ও বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে ইসি । ওই বৈঠকে ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত , ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল তৈরিসহ সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেবে ইসি । একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড . মো . আব্দুল আলীম ।

তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , প্রথম চ্যালেঞ্জ লজিস্টিক্যাল । দুই ধরনের ভোটের জন্য দুটি ব্যালট বাক্স দিতে হবে , দুই সেট ব্যালট পেপার ছাপাতে হবে । ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের তালিকাও পুনর্বিবেচনা করতে হবে । সময়মতো ভোটগ্রহণ শেষ করাও ইসির জন্য চ্যালেঞ্জের হবে । আব্দুল আলীম বলেন , রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দিনে গণভোটকে কতটা প্রাধান্য দেবে , এটাও ইসির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ । গণভোটের জন্য কমিশনের বর্তমান রোডম্যাপ পাল্টে নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে হবে । পাইলটিং না করে প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রেও কমিশনকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে ।