Image description
বিশৃঙ্খলার খেসারত দিচ্ছে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা * পদায়ন ও বদলিতে এখনো বহাল সিন্ডিকেট * শিক্ষার সমস্যাগুলো সমাধান করা হচ্ছে-শিক্ষা উপদেষ্টা

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য ৫ আগস্টের পর দৃশ্যমান কী হয়েছে-সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। এখনো শিক্ষা বিভাগে ফ্যাসিস্টদের রেখে যাওয়া লোকজন দিয়ে ঘেরা। যেখানে লোক পাওয়া যাচ্ছে না বা যেসব পদে বিতর্কিতদের নিয়োগ দিলে সামলানো যাবে না, সেসব গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য পড়ে আছে। অপরদিকে শিক্ষা খাতের পুরোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যোগ্যদের সরিয়ে অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য এবং বিগত সাড়ে ১৫ বছরের সুবিধাভোগীদের পদায়ন করা হচ্ছে।

প্রাপ্ত্য তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষা বিভাগের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন খালি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের (ডিজি) গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি অন্তত দুই মাস। ডিজি দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খানের স্থলে নতুন ডিজি চেয়ে ৬ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৪ অক্টোবর ড. মুহাম্মদ আজাদ খানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই পদে এখনো কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ডিজি পদে না থাকায় মাউশির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। অভিভাবকহীন শিক্ষা বিভাগ চলছে যার যার মতো করে।

অন্যদিকে, শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডেও (এনসিটিবি) স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদ খালি। আগামী শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজও চলছে ধীরগতিতে। এবারও বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন আওয়ামী সুবিধাভোগী এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) কর্মকর্তা। এই প্রতিষ্ঠানে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের রয়েছে কঠিন সিন্ডিকেট।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ৩০ অক্টোবর পিআরএলে যান এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সদস্য শিক্ষাক্রম, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ও অর্থ-এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ এখনো খালি রয়েছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর যুগান্তরকে বলেন, এনসিটিবির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি আছে।

এছাড়া জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল অফিসার পদও খালি রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সহকারী পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন), গবেষণা কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) শাখার পদও খালি রয়েছে। এসব পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

অপরদিকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন আওয়ামী সুবিধাভোগীরা। সম্প্রতি ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ড. মো. খাদেমুল ইসলাম। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সিনেট সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি সাত মাস ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ছিলেন। এরপর তাকে রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদায়ন করায় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিস্মিত। ১৪ অক্টোবর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব পেয়েছেন মো. তারেক আনোয়ার জাহেদী। এর আগে এই পদে দায়িত্বে থাকা মো. আলতাফ হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের রাজশাহী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে তিনি এই পদে বসেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পতিত আওয়ামী সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. সাবের মাহমুদ (রিফাত)। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতিও ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাকে রংপুর সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছিল। বছর না পেরোতেই আবারও তাকে ঢাকার ইডেন কলেজে বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে আবার তাকে বদলি করা হয়।

৫ আগস্টের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে সচিব (রুটিন দায়িত্ব) ছিলেন বিসিএস শিক্ষার ২৬তম ব্যাচের কর্মকর্তা ড. শরিফা নাছরীম। তাকে সরিয়ে সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

বিতর্কিতদের পদায়নের প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (সরকারি কলেজ-১) খোদেজা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেক বদলি নিয়ে কাজ করি। এছাড়া নানা কাজের চাপ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে।

এছাড়া রাজধানীর সরকারি ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙ্লা কলেজ ও তিতুমীর কলেজের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের কারণে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি বলে অভিযোগ করছেন দায়িত্বশীল শিক্ষা কর্মকর্তারা। অভিযোগ হচ্ছে, সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠনে বিরোধিতা করছেন এই শিক্ষকরাই। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপকের পদে পদোন্নতির জন্য আন্দোলনে নামেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক পদোন্নতি পেলেও বাকিরা আবার আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। রোববার সহকারী থেকে সহযোগী পদে পদোন্নতির জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি দ্রুত মেনে না নিলে কর্মবিরতির মতো আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। গত কয়েক মাসে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা একের পর এক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। এতে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর বহু খাতে সংস্কার হলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে নেই কোনো দৃশ্যমান প্রতিশ্রুতি বা অগ্রাধিকার। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক কাঠামোসহ সব জায়গায় এখনো অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শিক্ষা বেশি অবহেলিত।

শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সিআর আবরার) যুগান্তরকে বলেন, আমরা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণ করব। চলতি মাসে মাউশির ডিজি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এছাড়া যারা পদোন্নতি জন্য আন্দোলন করছেন, তাদের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখব। শিক্ষার সমস্যাগুলো সমাধান করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।