কৃষক বাড়তি খরচে ফসল ফলিয়ে ন্যায্য দাম পান না। আবার ভোক্তাও সুলভ মূল্যে কিনতে পারেন না পণ্য। লাভের সুফল যায় মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া যখন লাগামহীন, তখন নতুন করে সার উৎপাদনে ৮৩ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়িয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা হলো।
জানা যায়, সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের আগের দাম ছিল ১৬ টাকা।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে সার কারখানায় গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি পূরণে দাম বাড়িয়ে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিইআরসিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিই।
তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে, তাই আমাদের এলএনজি আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই। দৈনিক বাড়তি ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস দিতে গেলে আমাদের বছরে বাড়তি সাত কার্গো এলএনজি আমদানি করতে হবে।’
গতকাল রবিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এক সংবাদ সম্মেলনে সার কারখানার গ্যাসের নতুন দরের ঘোষণা দেয়। এটি আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে সমন্বয় হবে। এর আগে সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপর একই প্রস্তাব আলাদা করে জমা দেয় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কম্পানি। পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কম্পানিগুলোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ অক্টোবর গণশুনানি করেন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিইআরসি। শুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের কৃষি খাত। এতে সার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে বাড়তি খরচের চাপে পড়বেন কৃষকরা। ফলে খাদ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে, যা প্রকারান্তরে ভোক্তার ঘারেই পড়বে। এটি খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করবে বলেও তাঁরা জানান।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘এখন সরকার যদি সারে ভর্তুকি না বাড়ায়, তাহলে কৃষকরা সারের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারেন। সাধারণত সারসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়লে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হন, যা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনিতেই দেশের বাজারে চাল, আটা, সবজিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মোট কৃষি উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশই সার বা ফার্টিলাইজারের পেছনে খরচ হয়। অর্থাৎ, উৎপাদন খরচ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সারের ব্যয়ও বেড়ে যায়। যদি সারের উৎপাদন খরচ বাড়ে, তাহলে কৃষকের মোট উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ধানের দাম বাড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে চালের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রভাব ফেলবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন সরকার যদি সারে ভর্তুকি না বাড়ায়, তাহলে কৃষকরা সারের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারেন। সাধারণত সারসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়লে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হন, যা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ সার আমদানি করা হয়, আর বাকি ২০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত। আমদানি করা সারের সরবরাহে বিশেষ প্রভাব না পড়লেও স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় অবশ্যই বাড়বে, বিশেষ করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। এখন এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি মন্ত্রণালয় যদি কৃষক পর্যায়ে সারের দাম না বাড়ায় এবং ভর্তুকি বাড়িয়ে দেয় তাহলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও কৃষকের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থাৎ, সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধি সারের বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে পারে।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইএমএফ থেকে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার কারণে শর্ত হিসেবে ভর্তুকি কমানোর কথা। না হলে সংস্থাটি ঋণের কিস্তি ছাড় করবে না। এর আগে শর্ত পূরণ না হওয়ায় কয়েকটি কিস্তি আটকে দিয়েছিল। পরে অনেক দেনদরবার করে কিস্তি ছাড় করা হয়। এখনো পরবর্তী কিস্তি ছাড় করা নিয়ে আইএমএফ ‘ধীরে চলো নীতি’তে চলছে। সংস্থাটি অন্তর্বর্তী সরকারকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত পরবর্তী কিস্তি ছাড় করবে না।
ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় চাইলেই ভর্তুকি বাড়িয়ে দিয়ে সারের দর আগের স্তরে রাখতে পারবে এমনটা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তা ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ও ভর্তুকির ব্যাপারে অনেকটাই রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে। সুতরাং সব হিসাব-নিকাশেই সারের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সারের মোট চাহিদা প্রায় ৬৯ লাখ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। দেশে ব্যবহৃত সারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা) মো. খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউরিয়া সার গ্যাসনির্ভর হওয়ায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব উৎপাদনে পড়বে। তবে অন্য নন-ইউরিয়া সারের ক্ষেত্রে গ্যাসের ওপর তেমন নির্ভরশীলতা নেই। তবে সরকার এরই মধ্যে স্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, কৃষক পর্যায়ে কোনোভাবেই সারের দাম বাড়ানো হবে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও আমাদের উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সারের উৎপাদন খরচ বাড়লেও কৃষককে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে সরকার অন্যান্য উপায়ে মূল্য সমন্বয় করবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারের উৎপাদন খরচ বাড়লেও কৃষক পর্যায়ে সারের মূল্যবৃদ্ধি করা হবে না। কারণ বর্তমানে কৃষকরা আগের মতো উৎপাদনে উৎসাহিত নন; কৃষি উৎপাদন ধরে রাখতে হলে তাঁদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের পরিবারসহ অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষিকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার স্বার্থেই জরুরি।’
এদিকে চলমান গ্যাসসংকটসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষতির মুখে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন শিল্প-কারখানায় এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) গ্যাসের দাম আরো ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে শিল্প গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বিল ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম ৩১.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা করা হয়। ফলে নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পে নতুন বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত করাসহ শিল্পের সংকট আরো বাড়িয়ে তুলেছে বলে জানান শিল্পোদ্যোক্তারা।