Image description

শুক্রবার ছুটির দিন। দেশের ব্যস্ততম নগরীর বাসিন্দারা ছিল ছুটির আমেজেই। কিন্তু সকাল ঠিক ১০টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎ ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় পুরো দেশ। ২৬ সেকেন্ডের এই ভূমিকম্পেই যেন আড়মোড়া ভাঙে তিলোত্তমা নগরীর। আতঙ্ক উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একে একে আসতে থাকে আহত-নিহতের খবর। সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এই সংখ্যা।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে (রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত) সারা দেশে নিহত হয়েছে ১০ জন এবং আহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। আর নিহত এই ব্যক্তিদের মধ্যে পুরান ঢাকার ছিল তিন জন, ঢাকার মুগদাপাড়ায় একজন, নরসিংদীর পাঁচ জন এবং নারায়ণগঞ্জের এক জন।

৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশের নরসিংদীর মাধবদীতে। কিন্তু এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সারা দেশেই। ঢাকায় এই মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার ইতিহাস নিকটবর্তী সময়ে কমই আছে। তবে আজকের এই ভূমিকম্প নতুন করে কাঁপিয়ে তুলেছে নগরবাসীকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আজকের ভূমিকম্পে একাধিক ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।

রাজধানীর বাড্ডার লিংক রোডে একটি পাঁচ তলা ভবন হেলে পড়ে। রামপুরা টিভি রোডে কয়েকটা বিল্ডিং একটা অন্যটার ওপর হেলে পড়ে। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের একটি ছয়তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় চারপাশে বড় ফাটল ধরেছে। পঙ্গু হাসপাতালের সামনের অংশে ওপর পর্যন্ত বড় ফাটল ধরার খবর পাওয়া যায়। সূত্রাপুর স্বামীবাগে আটতলা একটি ভবন অন্য একটি ভবনে হেলে পড়ার খবর পাওয়া যায়। কলাবাগানের আবেদ ঢালী রোড একটি সাততলা ভবন হেলে পড়েছে বলেও জানা যায়।

পুরান ঢাকায় ভূমিকম্পে নিহতের ঘটনায় উদ্ধার কাজে অংশ নেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা/ বাংলা ট্রিবিউনপুরান ঢাকায় ভূমিকম্পে নিহতের ঘটনায় উদ্ধার কাজে অংশ নেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা/ বাংলা ট্রিবিউন

রাজউকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এছাড়া বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে পাঁচ হাজার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি। বাকি ২১টির মধ্যে মোহাম্মদপুরে ছয়টি, ডেমরায় তিনটি, মিরপুরে সাতটি, রমনায় একটি, তেজগাঁওয়ে একটি, মতিঝিলে দুটি ও ধানমন্ডিতে একটি।

২০২৪ সালে ঢাকা অঞ্চলের ২১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩০ ভবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে রাজউক।

রাজউক আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অংশ হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে. মধুপুর ফল্টে (টাঙ্গাইল), যা ঢাকার নিকটবর্তী, ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকা শহরের প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। দিনের বেলায় এমন ভূমিকম্প আঘাত হানলে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে এবং আরও ২ লাখ ২৯ হাজার মানুষ আহত হতে পারে বলে জানিয়েছে রাজউক।

জরিপটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পরিচালিত হয়েছে।

রাজউকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রায় ২.৬২ ট্রিলিয়ন টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে আরও ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৪.৬২ ট্রিলিয়ন টাকা) ব্যয় করতে হবে।

অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এসব ভবনগুলো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বেড়ে যাওয়ার পেছনে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থাকে দায়ী মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হওয়ার পেছনে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব—সবগুলো কারণই মিলেই সমস্যাটা তৈরি হয়। আমরা একে অপরকে দোষ দিই। অনেক জায়গায় যেসব স্থানে ভবন বানানোর কথা নয়— যেমন নিচু ভূমি, জলাশয় বা জলাভূমি— সেসব এলাকায়ও ভবন গড়ে উঠেছে। সেখানে তো মাটির চরিত্রই দুর্বল। তবু আমরা নগর সম্প্রসারণ করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি খরচ কমানোর জন্য নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছি, আর পুরোপুরি বিল্ডিং কমপ্লায়েন্স মানছি না। রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থাও অনেক সময় সঠিকভাবে নজরদারি করছে না। ফলে গড়ে উঠেছে একটি বিল্ডিং-কনস্ট্রাকশন ইকোসিস্টেম, যেখানে সবাই কোনও না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।’

ঢাকার আবাসন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে

সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আরেকটি দিক হলো—যারা ভবনে থাকেন, অর্থাৎ ভাড়াটিয়ারা—তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বহু মালিক নিজেরা ভবনে থাকেন না; বিভিন্ন নিম্নমানের উপাদান দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করেন এবং পরে ভাড়াটিয়াদের কাছে টাকা নেন। ফলে ভূমিকম্পসহ যেকোনও দুর্ঘটনায় ঝুঁকিতে পড়েন ভাড়াটিয়ারাই। তাই রাষ্ট্র এবং সংসদকে সব পক্ষকে নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।’

নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায় সম্পূর্ণভাবে বাড়ির মালিকের। কারণ ভবনের মালিক তিনি এবং তিনি সেখান থেকে ভাড়া পান। ভাড়া যতই হোক না কেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তাকে নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতেই হবে—এখানে কোনও ব্যতিক্রম নেই। আইন অনুযায়ী এমনকি আপনি নিজেরাও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে থাকতে পারবেন না। আইন তা অনুমতি দেয় না। তাই রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার পুরো দায়ই মালিকের ওপর। রাষ্ট্রের আইনের অধীনে তাকে সেই দায় পালন করতেই হবে।’

আইনের প্রয়োগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল। রাজনৈতিক প্রভাব এবং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা—যেখানে ৭০ শতাংশের বেশি গভার্ন্যান্স সমস্যা—এসবের কারণে যে সংস্থাগুলো কমপ্লায়েন্স দেখার কথা, তারা কতজনকে আসলে আইনের আওতায় আনতে পেরেছে? যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের কাউকেই আমরা আইনের মুখোমুখি করতে পারিনি। তাহলে তো মেসেজটা পরিষ্কার; নন-কমপ্লায়েন্ট ভবন নির্মাণ করলেও চলবে, দুর্নীতি করলেও শাস্তি নেই। বড় বড় পদে থাকা যারা দায়ী ছিলেন, তাদের কাউকেই আইনের সম্মুখীন করা হয়নি। ফলে উল্টো একটা বার্তা গেছে—দুর্নীতি করেও পার পাওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা নিয়ম পরিবর্তন করে, ঢাকা শহরের ফিজিক্যাল প্ল্যান পরিবর্তন করে আরও বড় বড় ভবন বানাতে পারছে। তারা রাস্তার পাশেই উচ্চ-ঝুঁকির ভবনের লাইসেন্স নিয়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্রে এই সুবিধাভোগী চক্র, রাজউকের দালাল চক্র, তাদের প্রভাব—সব মিলিয়ে এক ধরনের নেক্সাস তৈরি হয়েছে। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা—বিল্ডিং ধসের ঘটনার পরে আমরা কঠোরভাবে বিল্ডিং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করব, যারা এই নেক্সাসে ছিল তাদের চিহ্নিত করব, নতুন ভবন নির্মাণে কঠোর নিয়ম মানা হবে—জিরো টলারেন্স থাকবে।’

রাজধানীর মুগদা এলাকায় ভূমিকম্পের সময় নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে মারা যান এক নিরাপত্তাকর্মী/সংগৃহীতরাজধানীর মুগদা এলাকায় ভূমিকম্পের সময় নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে মারা যান এক নিরাপত্তাকর্মী/সংগৃহীত

আজকের ভূমিকম্প আমাদের কী বার্তা দিয়ে গেলো? এ বিষয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘আজকের ভূমিকম্প মেসেজ দিচ্ছে যে আমাদের বড় আকারে ভূমিকম্প আসছে। যেটা অনেক দিন ধরে আমরা বলছিলাম। অনেকে হয়তো সেই অর্থে উদাসীন ছিল। কিন্তু আজ এত বড় ঝাঁকুনির পরে ঢাকা শহরের প্রতিটা অধিবাসী অনুভব করতে পারে বিপদ নিকটে। যদি নিকটেই হয় তাহলে আমরা যারা অধিবাসী তারা আমাদের নিকটবর্তী বা আমাদের কমন স্টেকহোল্ডার যারা আছে যারা এই নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করবে তাদের একটা ঝাঁকুনি দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আপনি যদি বাড়ির ভাড়াটিয়া হোন বাড়ি মালিককে বলতে হবে চেক করেন বিল্ডিংটা কেমন রয়েছে এখন। বিল্ডিংটা দুর্বল হলে তার স্ট্রেংথ বাড়ানোর জন্য কাজ করেন। তাদের রাস্তাঘাট, স্পেসগুলো ঠিক আছে কি-না তার রেসকিউ করার জন্য কোনও অফ স্পেস আছে কি-না সেগুলো নিয়ে কাজ করবে। অন্যান্য বড় বড় যে সংস্থাগুলো আছে তাদের ওপর অর্পিত সরকারের দায়িত্ব সে দায়িত্ব তারা পালন করছে কিনা, প্লানিংয়ের কোনও ভায়োলেশন যেন না করা হয়, ভায়োলেশন করে যেন বিল্ডিং অনুমোদন না দেয়া হয়, সেগুলো করতে হবে।’

অতীতে যত ধরনের অনিয়ম হয়েছে তার একটা শ্বেতপত্র বানানো দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনিয়মের মধ্যে বিল্ডিং তৈরি থেকে শহরের সম্প্রসারণ এই ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে স্বজনপ্রীতির সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করা দরকার। এবং অবশ্যই একটা শেতপত্র করা দরকার যে ঢাকার বিধ্বংসী নগরায়ণের পেছনে কারা ছিলেন? সরকারি আমলা থেকে শুরু করে আমাদের কেউ...যারা ছিলেন তাদের চিহ্নিত করা দরকার। এটা করতে পারলে তখন আমরা করণীয় যেটা আছে আমরা নতুন যাত্রা শুরু করতে পারবো।’

উল্লেখ্য, বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার কাছে ফরিদপুরে গত ১৫ বছরের মধ্যে দুইবার চার মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে বলে নথিবদ্ধ করেছে ভূমিকম্প শনাক্তকারী সংস্থা আর্থকোয়েকট্র্যাক। তবে গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে নথিবদ্ধ করা হচ্ছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে; নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পকে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।