শুক্রবার সকাল ১০টা। ছোট ছেলে মেহরাব হোসেন রিমনকে সঙ্গে নিয়ে মাংস কিনতে বেরিয়েছিলেন সদরঘাট বিক্রমপুর গার্ডেন সিটির মার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুর রহিম। অল্প কিছুক্ষণ পর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী। পরিবারের সদস্যরা খোঁজখবর নেয়ার জন্য কল দিলে আব্দুর রহিমের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে, খবর আসে পুরান ঢাকার বংশালের কসাইটুলীতে সাত তলা একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে পড়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহত আব্দুর রহিমের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা তখনো কল্পনা করতে পারেনি নিহতদের মধ্যে এই দুইজন আছেন।
জুমার নামাজ শেষেও বাসায় না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেন রহিমের ভাই নাছির। এর মধ্যে নিহতদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চেহারা স্পষ্ট না থাকায় চিনতে পারেননি স্বজনরা। সন্দেহবশত খোঁজ নিতে আসেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে। এখানে এসে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন নাছির। দেখেন ভাই আব্দুর রহিম ও ভাতিজা মেহরাব হোসেন রিমনের লাশ পড়ে আছে মর্গে। মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নিহত আব্দুর রহিমের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার বশিকপুর ইউনিয়নে। আর তার ছেলে রিমন সুরিটোলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। শুধু বাবা ছেলেই নয়, গতকাল পুরান ঢাকার বংশাল কসাইটুলী এলাকায় নয়নের দোকানের সামনে ভূমিকম্পে সাত তলা ভবনের রেলিং ধসে পড়ে নিহত হয়েছেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম। মায়ের সঙ্গে মাংস কিনতে গিয়ে আর বাসায় ফেরা হয়নি তার। তার সঙ্গে তার মা নুসরাত জাহান আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাফির মা প্রচণ্ড ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে বারবার ছেলের খোঁজ নিচ্ছেন। কিন্তু মাকে জানানো হয়নি তার ছেলে রাফি না ফেরার দেশে চলে গেছে। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে বিল্ডিংয়ের রেলিং ধসে পড়ে রাফি ও তার মায়ের ওপর। মুহূর্তেই রাফির মাথা ও মুখ থেঁতলে যায়। স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাফিকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত রাফিউলের সহপাঠী ইমতিয়াজ উদ্দিন নাদিম বলেন, সে তার মায়ের সঙ্গে বাজার করতে বাসা থেকে বের হয়েছিল। সকালে ফেসবুকের একটি ভিডিওতে দেখি ভূমিকম্পে রেলিং ধসের ঘটনায় রাফির মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পরে হাসপাতালে এসে দেখি সে আর নেই এবং ওর মা-ও গুরুতর আহত হয়েছেন। তার মাকে রাফির মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। তার মা বারবার রাফি কেমন আছে জিজ্ঞেস করছে, আমরা উনাকে এখনো রাফির মৃত্যুর খবর জানাইনি। তিনি বলেন, সে খুবই শান্তশিষ্ট একটা ছেলে ছিল। রাফি হলে সিট পেলেও মা ও বোনের সঙ্গে বংশালের বাসায় থাকতো। তাদের গ্রামের বাড়ি বগুড়াতে। তারা দুই ভাইবোন, তার বাবা দিনাজপুরে চাকরি করেন।
আমার কলিজাটা জ্বলে যায়, আমার ভাই আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতো না বলে মর্গের সামনে আর্তনাদ করছিলেন নিহত আব্দুর রহিমের ভাই নাছির। তিনি বলেন, আমার ভাই সকাল ১০টার দিকে মাংস কেনার জন্য ভাতিজাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিল। ভূমিকম্পের পর তার ফোনে কল দিলে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এর মধ্যে শুনতে পাই ভবনের রেলিং ধসে পড়ে তিনজন নিহত হয়েছে। চেহারা স্পষ্ট না থাকায় আমরা চিনতে পারিনি। জুমার নামাজের পরও বাসায় না এলে আমরা দিগ্বিদিক খোঁজ করতে থাকি। পরে খোঁজ নিতে দুপুর ২টার দিকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে দেখি- আমার ভাই আর ভাতিজার লাশ পড়ে আছে। আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি আমার ভাই এভাবে মারা যাবে। তিনি বলেন, আমার ভাই সদরঘাটের বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি মার্কেটে ফেব্রিকসের ব্যবসা করতেন। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছোট ছেলে মেহরাবকে নিয়ে রাজধানীর সুরিটোলা স্কুলের পেছনে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আমার ভাই খুব ভালো মানুষ। দুই বছর আগে হজ করে আসছে। আমার ভাইকে যেন আল্লাহ্ জান্নাতবাসী করেন।
নিহত আব্দুর রহিমের বন্ধু আজিম বলেন, রহিম খুবই ভালো মানুষ ছিল। কারও সঙ্গে তার কখনো মনোমালিন্য হয়নি। আমি নিজেই ভূমিকমেপ নিহত তিনজনের ভিডিও শেয়ার করেছিলাম। কিন্তু চেহারা রক্তমাখা থাকায় চিনতে পারিনি। দুপুর ২টার পর শুনি ওই ভিডিওতে সে ছিল। কখনো কল্পনাও করিনি রহিম এ ঘটনায় মারা যাবে।
যে দোকানটির ওপর ছাদের রেলিং ভেঙে পড়েছে, সে দোকানের মালিক নয়ন বলেন, ভূমিকম্পে পুরো বিল্ডিং দুলছিল। আল্লাহ্ আমারে বাঁচাইছে। দোকানের ওপর ছাউনি থাকায় অনেকে রক্ষা পেয়েছে। ভূমিকম্পে ভবনটির রেলিং ভেঙে ছাউনির ওপর পড়ে। মুহূর্তেই দেখি একজন শিশুসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন। ধরে দ্রুত রিকশা ও ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনি আরও বলেন, ছাউনির ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। ছাউনির বাইরে যারা ছিলেন, তাদের মাথায় ওপর সরাসরি ইট পড়েছে। ছাউনি ভেঙে আমার স্টাফ সহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। শুক্রবার দেখে হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। না হলে এখানে বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সব সময় থাকেন। তখন হতাহতের সংখ্যা অসংখ্য হতো।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজহারুল ইসলাম খান বলেন, ভূমিকম্পে আহত হয়ে ২০ জনের মতো হাসপাতালে এসেছিলেন। এদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। একজন বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।