৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপেছে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা। হয়েছে জানমালের ক্ষতি। শুক্রবার সকালের এই কম্পন ছিল মাঝারিমাত্রার। কিন্তু ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে ব্যাপক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগর, শহর ও বসতি গড়ার কারণে রীতিমতো টাইমবোমার উপর বসে আছে মানুষ। যথাযথ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি হতে পারে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আমরা টাইমবোমার উপর বসে আছি। যখন ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) তৈরি করা হয় তখন প্রাক সমীক্ষা নির্ভর একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে রাজউক কনসালটেন্ট নিয়োগ করে কোটি কোটি টাকার জরিপ হয়। এতে বলা হয়, ঢাকার বহুতল ভবনের ৯৪ শতাংশ অননুমোদিত এবং অনুমোদন নিয়ে ব্যত্যয় করা হয়েছে। ঢাকায় যতো ভবন এর ৬৫ শতাংশ ১,২,৩ তলা। এর বাইরে ৩৫ শতাংশ ভবন বহুতল। এর ৯৪ শতাংশই অবৈধ বা অনুমোদন ব্যত্যয় করে করা। আমরা সাংঘাতিক অনিরাপদ শহরে বাস করছি। যার কারণে ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা অথবা অন্যান্য বিপদের সময় বোমার মতো বিস্ফোরণ হতে পারে। এই অবস্থা উত্তরণের জন্য গত ২৫ বছর আমরা পরিবেশকর্মীরা কাজ করছি। বলেছি রাষ্ট্র অনুমোদিত একটি নিরাপদ নগরীর জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করা হোক। এটার খসড়াও তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সমস্ত সভ্য শহরগুলোতে প্রতিবছর ভবন ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে তার সার্টিফিকেশন দেয়া হয়। এমনকি ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটানেও আছে। যেকোনো দুর্ঘটনা, সেটা মগবাজার, বেইলি রোড বা ফুলবাড়ীয়ায় হোক, দুর্ঘটনার পর বলা হয় অবৈধভাবে তৈরি ভবন। আজ যেটা হলো সেটা নতুন একটা মাত্রা যোগ হলো। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন, আমরা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। এবারের ভূমিকম্প একটা নতুনভাবে সতর্ক বার্তা। একসময় তিতাসের সহজলভ্য গ্যাস থাকার কারণে যত্রতত্র গ্যাস লাইন দেয়া হয়, বৈধ বা অবৈধ। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে শহরের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। ভূমিকম্প হওয়ার পর গ্যাসলাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর স্পার্ক আর গ্যাস মিলে বোমের মতো ব্লাস্ট করবে। আমাদের এখুনি উদ্যোগ নিয়ে শহরকে নিরাপদ করতে হবে। প্রতিটা বাড়ি পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে ভবন ভেঙে বাঁচার মতো, নিরাপদ করার মতো ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ১৮৫৭ সালে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ সাড়ে আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৭৬২ সালে টেকনাফ আইল্যান্ডে ভূমিকম্পে কয়েক মিটার উঁচু হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ২০০৩ সালে বরকলে (রাঙ্গামাটি) ৫.৪, ২০১৫ সালে সিলেটের কমলগঞ্জে ৫.৩ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়। শুক্রবারের ভূমিকম্প নরসিংদীর মাধবদী অঞ্চলে এর উৎপত্তি এবং ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। যার মাত্রা ছিল ৫.৭। নিকট অতীতে এতো বড় মাত্রার ভূমিকম্প আর হয়নি। তাও আবার ঢাকার এতো নিকটে। এ কারণে আমরা সার্ফেস ওয়েবটা এত অতিমাত্রায় অনুভব করেছি। ডানে, বামে, উপরে, নিচে ওয়েব হয়েছে। তারপরও স্কেল অনুযায়ী এটা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। বাংলাদেশ তিনটা প্লেটের একটা সংযোগস্থল। আমরা ভূমিকম্প হতে পারে এমন প্রবল অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থান করছি। পৃথিবীর মিলিয়ন মিলিয়ন টনের একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। একটা বিশাল ফ্রিকশনাল ফোর্স আটকে রাখার চেষ্টা করছে। দু’টা ফোর্স পরস্পর বিপরীতমুখী, সাংঘর্ষিক শক্তি কাজ করছে। এই যে আটকে রাখার কারণে একটা স্থিতিশক্তি সঞ্চিত হয়। ইন্ডিয়ান প্লেট, বার্মিজ প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি সবসময় বিদ্যমান। আবার বাংলাদেশের ভূগঠন নরম শিলা দিয়ে তৈরি। ভূমিকম্পের কম্পন মাটির নিজস্ব কম্পাঙ্ক ও ভবনের কম্পাঙ্ক একসঙ্গে মিলে গেলে তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে যে দু’টা বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল এর ওজন ছিল সাড়ে চার টন। একেকটা বোম, একেকটা শহরকে ধ্বংস করে দেয়। তার তুলনায় একটা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ৬০ লাখ টন শক্তি সঞ্চিত শক্তি বিস্ফোরণ হয়। প্রতিদিন বিশ্বে অন্তত ৫০টি ভূমিকম্প হয়। কিন্তু মাত্রা কম হওয়ায় তা আমরা অনুভব করতে পারি না। বাংলাদেশ ‘ত্রিপল জাংশন’ জায়গায় অবস্থান করছে। ডাউকি ফল্ট নেত্রকোনা থেকে শুরু করে সিলেট পার হয়ে ভারতের অনেকদূর বিস্তৃত। আরেকটা ফল্ট হচ্ছে সিলেট অঞ্চল থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ফল্টটা মৌলভীবাজার, কুমিল্লা হয়ে ঢাকা ও এর আশপাশে পড়েছে। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটা জায়গা আছে যেখানে শতাধিক বছর ধরে ভূমিকম্প হয়নি। এখানে অনেক শক্তি সঞ্চিত রয়েছে। এই শক্তি যখন বের হবে বৃহৎ ভূমিকম্প হবে। আমরা যে জোনে আছি এখানে ভূমিকম্প হবে নিশ্চিত। তবে কবে সংঘটিত হবে এটা দিনক্ষণ বলা যাবে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
ড. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সেইসঙ্গে অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত। রানা প্লাজা কলাপস যখন করলো, দীর্ঘদিন ধরে উদ্ধার কাজ করতে হলো। ঢাকায় ভূমিকম্পের কারণে কয়েকটা বিল্ডিং ধস হলে আমরা যাওয়ার মতো রাস্তাটাও পাবো না। এরসঙ্গে বিভিন্ন লাইন থেকে অগ্নিসংযোগেই মারা যাবে বহু মানুষ। তিনি বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধে কী কী করণীয় এটা আমাদের শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর অনেক সভ্যতা কিন্তু ভূমিকম্পে বিলীন হয়ে গেছে।