কোনও সংস্থার কাছে যদি গোপন কারাগার থাকে তাহলে তা জুলাই জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। গণভবন; যেটি আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেটি এখন হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরের প্রধান কার্যালয়। একইসঙ্গে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যেসব গোপন কারাগারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা, সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরকে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস, নিদর্শন ও দলিলাদি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে জারি করা অধ্যাদেশে এসব বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২৩ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা নীতিগতভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশের অনুমোদন দিয়েছি। আপনারা জানেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে আমাদের অনেক তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকের স্থায়ী অঙ্গহানি হয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।”
আইন উপদেষ্টা জানান, জাদুঘরটি দেশের প্রচলিত কোনও জাদুঘরের অধীন শাখা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন কাঠামো ও প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। জাদুঘর পরিচালনার জন্য নতুন জনবল নিয়োগ, প্রশাসনিক কাঠামো নির্ধারণ ও বাজেট বরাদ্দের বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
এরপর গত ৩০ অক্টোবর অধ্যাদেশের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। তখন আসিফ নজরুল বলেন, “আগে যে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, গণহত্যার দায়ে যার বিচার হচ্ছে, ওনার যে বাসভবন, যেটি উনি ব্যবহার করতেন, সেটি জুলাই জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।”
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “এটি একটি পৃথক জাদুঘর হবে। এটি জাতীয় জাদুঘরের কোনও শাখা বা প্রশাখা হবে না। এর গুরুত্ব ও আবেদন বিবেচনা করে সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই অধ্যাদেশ করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশের আলোকে বিভিন্ন জায়গায় থাকা আয়নাঘরগুলোও জুলাই জাদুঘরের শাখা জাদুঘর হিসেবে সম্প্রসারণ করা যাবে।”
গোপন কারাগার কী
‘আয়নাঘর’ শব্দটির পরিচিতি আসে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গুম-সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি গঠন করে। কমিশন তদন্তের সময় ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ৮টি গোপন কারাগারের সন্ধান পায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু জায়গায় কমিশনের সদস্যরা পরিদর্শন করে এসব আটককেন্দ্রের মধ্যে কাঠামোগত মিল পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুম হওয়া পরিবারের কিছু সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকার তিনটি ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করেন। সেদিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “বাংলাদেশে যত ‘আয়নাঘর’ আছে, প্রতিটি খুঁজে বের করা হবে। গুম কমিশনের তদন্ত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত অনুযায়ী এর সংখ্যা কয়েকশত, ৭০০ থেকে ৮০০-এর মতো হতে পারে। বোঝা যাচ্ছে এটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ রকম ‘আয়নাঘর’ ছিল।”
জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ গোপন কারাগারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “এরূপ কোনও গুপ্তস্থান যা ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট সরকার বা তার কোনও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অপহরণকৃত ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অন্তরীণ রেখে অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আয়নাঘর নামেও অভিহিত হয়েছে।”
আর জাদুঘরের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “ধারা ৩-এর অধীন প্রতিষ্ঠিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর, তবে ভবিষ্যতে সমরূপ স্থাপনা আবিষ্কৃত হলে এবং জাদুঘর হিসেবে ঘোষিত হলে তাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।”
অধ্যাদেশে বলা হয়, এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য জাদুঘরের বিভিন্ন বিভাগ, অনুবিভাগ, শাখা ও দফতর থাকবে। যেক্ষেত্রে কোনও গোপন কারাগার কোনও সংস্থার অধীন থাকে সেক্ষেত্রে উক্ত সংস্থা তা জাদুঘরের নিকট যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবে এবং উক্ত মানবতাবিরোধী কারাগারসমূহ জাদুঘরের শাখা জাদুঘর হিসাবে পরিগণিত ও পরিচালিত হবে।
জাদুঘরে কী কী থাকবে
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও পলায়ন সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্মৃতিচিহ্ন, পূর্ববঙ্গের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নিদর্শন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিরোধী কার্যক্রম ও ফ্যাসিবাদের উত্থান সংক্রান্ত স্মৃতিচিহ্ন, প্রামাণ্য দলিল, সংশ্লিষ্ট বস্তু ও নিদর্শন অনুসন্ধান, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের কাজ করবে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর।
এছাড়া সংগৃহীত সব নিদর্শনের তালিকা প্রণয়ন ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ, সব নিদর্শনের ফটো এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে অনুকৃতি প্রস্তুত ও সংরক্ষণ, ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি এবং একাধিক স্থানে সংরক্ষণ, ওয়েবসাইট স্থাপনের মাধ্যমে জাদুঘরের কার্যাবলির প্রচারণা, সাময়িকী, পত্রিকা, গ্রন্থ, সংকলন, ডিজিটাল প্রতিকৃতি, ভার্চুয়াল জাদুঘর, চলচ্চিত্র নিদর্শন, ভিউ কার্ড, পোস্টার এবং নিদর্শনের অনুকৃতি তৈরি, প্রকাশ, প্রচার, দেশি-বিদেশি প্রদর্শনী ও মেলায় অংশগ্রহণ, বিনিময় ও বিপণনের কাজও করবে।
এছাড়া জুলাই গণঅভ্যূত্থানের প্রেক্ষাপট বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা, বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাসভিত্তিক প্রদর্শনী, সম্মেলন, বক্তৃতামালা, সেমিনার, কর্মশালা এবং সভার আয়োজন করবে জাদুঘর। জাদুঘর পরিচালনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতকরণ, গণতান্ত্রিক চর্চা, মানবাধিকার বিষয়ক কার্যক্রম, অনুরূপ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, জাদুঘর পরিচালনায় প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া জাদুঘরের বিশেষায়িত বা গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে অথবা জরুরি প্রয়োজনে সহায়তাকল্পে কোনও অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিতকরণ এবং তাদের সম্মানি, পারিশ্রমিক বা অনুদান প্রদান, বিশেষজ্ঞ বিনিময় কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ বা অনুরূপ কোনও কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য কোনও দেশি বা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, কোনও বিদেশি জাদুঘর বা আন্তর্জাতিক কোনও সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা-স্মারক বা চুক্তি সম্পাদন, সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অনুরোধে সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি, রচনা বা দলিল প্রস্তুত; জাদুঘরের সাধারণ পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন ও নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় উপকরণ, যন্ত্রপাতি এবং যানবাহন সংগ্রহ ও ব্যবহার এবং এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত কার্যক্রম সম্পাদন।
জাদুঘর পরিচালনায় থাকবে পর্ষদ
জাদুঘর পরিচালনার জন্য একটি পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে অধ্যাদেশে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে নিযুক্ত শিক্ষা, ইতিহাস, সাহিত্য বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনও প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ একজনকে এই পরিষদের সভাপতি করা যাবে। এছাড়া এই পরিষদের সদস্য হিসেবে থাকবেন আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, অর্থ বিভাগ কর্তৃক মনোনীত যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, সরকার কর্তৃক মনোনীত সরকারি অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন অধ্যাপক, জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট গবেষণাধর্মী কাজ বা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে একজন প্রতিনিধি, সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন প্রথিতযশা কিউরেটর অথবা জাদুঘর ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, সরকার কর্তৃক মনোনীত জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারের একজন সদস্য এবং আহত বা অংশগ্রহণকারী অথবা তাদের পরিবারের একজন সদস্য। জাদুঘরের মহাপরিচালক নিয়োগ দেবে সরকার এবং তিনি পরিষদের সদস্য সচিব হবেন।
এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গুম, খুন, নির্যাতন, শাপলা ম্যাসাকার, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গ অথবা তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত তিন জন সদস্য।
এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ব্যতীত সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যরা তিন বছরের জন্য তার পদে থাকতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ একবার দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মনোনীত হতে পারবেন। পর্ষদের যেকোনও সদস্য সরকারকে পদত্যাগপত্র পাঠানোর মাধ্যমে পদত্যাগ করতে পারবেন। এছাড়া জাদুঘরের একজন পরিচালক থাকবেন, যাকে সরকার নিয়োগ দেবে এবং তিনি মহাপরিচালককে প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবেন।
জাদুঘরে থাকবে প্রবেশমূল্য, পরিষদের তহবিল চলবে বরাদ্দ ও অনুদানে
পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে সাধারণ মানুষ জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবেন। এছাড়া পরিষদের পরিচালনায় তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিলে আর্থিক মঞ্জুরি দেবে সরকার এবং বিশেষ অনুদানও দেবে। এছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি এমনকি ব্যক্তিও কোনও শর্ত ছাড়া অনুদান দিতে পারবেন। জাদুঘরের জন্য বিদেশ থেকে কোনও সহযোগিতা কিংবা অর্থায়ন এলে তার জন্য আগে থেকে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে।
জাদুঘরের নিদর্শন ধ্বংস করার শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড
জাদুঘরের স্থাবর নিদর্শন বিনষ্ট বা ক্ষতিসাধন করলে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানার কথাও বলা আছে অধ্যাদেশে। আর অস্থাবর নিদর্শন ধ্বংস বা বিনষ্ট করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে অধ্যাদেশে। এছাড়া নিদর্শনের ওপর খোদাই বা লেখালেখি করলে এক বছরের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।