রাজশাহী অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা নানা অনিয়ম, তথ্য জালিয়াতি, ঘুষ লেনদেন ও বিধিবহির্ভূত অনুমোদনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তদন্তে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) গঠিত তিন সদস্যের কমিটি এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রশাসনিক বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তদন্তে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে, তারা হলেন— মাউশি রাজশাহী অঞ্চলের তৎকালীন পরিচালক (কলেজ) বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি, সহকারী পরিচালক মো. আলমাছ উদ্দিন এবং সেসিপ প্রকল্পের তিন কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র প্রামাণিক, মো. আসমত আলী ও মো. রাশেদুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই আনীত অভিযোগ দালিলিকভাবে প্রমাণিত।
প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি আইনজীবী মো. এনামুল হক, মো. তোরাব আলী পারভেজ, মো. কাওসার আলী এবং জাতীয়তাবাদী কলেজ শিক্ষক সমিতির পক্ষে মো. এরশাদ হোসেন ও রুহুল আমিনের জমা দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে এ তদন্ত শুরু হয়। এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে অভিযোগকারী, অভিযোগ উঠা কর্মকর্তারা এবং মাউশির আঞ্চলিক পরিচালকের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ ও নথিপত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে তদন্তকাজ শুরু হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. যহুর আলী। কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন মাউশির উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ সফিউল বশর।
তদন্ত শেষে গত ১৪ অক্টোবর জমা দেওয়া কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যানবেইস ডাটাবেসে কোনো তথ্য না থাকা সত্ত্বেও ছয়জন প্রভাষক ও এক অফিস সহকারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা এবং ব্যানবেইস নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন। নাচোল মহিলা কলেজের আট শিক্ষককে ২০১৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কাগজপত্রে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে নিয়োগ দেখিয়ে তৃতীয় শিক্ষক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির আগেই নিয়োগ দেখানোর বিষয়টি স্পষ্ট জালিয়াতি বলে উল্লেখ করেছে কমিটি।
এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির অনুমতি ছাড়া সমন্বয় এমপিওর কোনো সুযোগ না থাকলেও বাশেরবাদা ও কাকনহাট ডিগ্রি কলেজের তিন প্রভাষককে অনুমতিবিহীনভাবে এমপিওভুক্ত করা হয়। একইভাবে ২০১৯ সালে মোজাহার হোসেন ডিগ্রি কলেজের পাঁচ শিক্ষককে এনটিআরসিএর সুপারিশ ছাড়াই কমিটি কর্তৃক নিয়োগ দিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়, যা ২০১৬ সালের পর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, দুটি অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয়—‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ এবং ‘অতীশ দীপংকর বিশ্ববিদ্যালয়’- এর ডিগ্রি নিয়ে দুই শিক্ষককে এমপিও দেওয়া হয়েছে, যদিও প্রতিষ্ঠান দুটি ইউজিসি অনুমোদিত নয় এবং ব্যানবেইস ডাটাবেসেও তাদের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নাটোরের মহারাজা জে. এন. কলেজের এক শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চার লাখ টাকা গ্রহণের অভিযোগের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ লিখিতভাবে জানান— সহকারী পরিচালক মো. আলমাছ উদ্দিনের উপস্থিতিতে সেসিপ কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র প্রামাণিক এমপিও ফাইলের কাজ করে দেওয়ার কথা বলে অর্থ দাবি করেছিলেন। পরবর্তীতে অর্থ লেনদেন নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।
তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ব্যানবেইস ডাটাবেস জালিয়াতি, তারিখ টেম্পারিং, ঘুষ লেনদেন, বিধিবহির্ভূত তৃতীয় শিক্ষক তালিকা প্রণয়ন, অনুমতি ছাড়া সমন্বয় এমপিও, অনুমোদনবিহীন ডিগ্রিতে এমপিও প্রদান এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য— সব অভিযোগেরই দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জরুরি প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক মো. যহুর আলী বলেন, ‘প্রতিবেদনটি আমাদেরই তৈরি করা, স্বাক্ষরও আমাদের। এখানে সব অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।’
মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) ফজলুল হক মনি বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল তদন্ত কমিটি গঠন এবং প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক এখন মন্ত্রণালয়।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও আইন শাখার উপসচিব আশরাফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমার তথ্য জানা নেই। তদন্ত প্রতিবেদন না দেখে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আগামী রোববার প্রতিবেদনের কপি দেখে জানাতে পারব কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’