সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে জাতীয় বেতন কমিশন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আগামী সোমবার (২৪ নভেম্বর) সচিবালয়ে বৈঠকও করতে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকার এলে এটি বাস্তবায়ন করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা।
বিষয়টি ভালোভাবে নেননি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা চাইছেন, বর্তমান সরকারই এটি বাস্তবায়ন করুক। আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তারা। ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে জটিলতাও তৈরি হয়েছে। যদিও বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারই উদ্যোগ নিয়ে পে কমিশন গঠন করায় তাদেরও সদিচ্ছার ঘাটতি নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে ২৪ নভেম্বরের বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খান।
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে সভাপতি করে ২৩ সদস্যের জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ গঠন করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, কমিশনের প্রথম সভার তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। দীর্ঘ বিরতির পর সরকারি কর্মজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো তৈরির জন্য এ কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে এই বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে। এর আগে ১ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাধারণ নাগরিক, সরকারি চাকরিজীবী, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন বা সমিতির কাছ থেকে অনলাইনে প্রশ্নমালার মাধ্যমে মতামত সংগ্রহ করে কমিশন।
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে সভাপতি করে ২৩ সদস্যের জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ গঠন করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, কমিশনের প্রথম সভার তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। দীর্ঘ বিরতির পর সরকারি কর্মজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো তৈরির জন্য এ কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের আমলেই কার্যকর হবে নতুন পে স্কেল। কিন্তু সম্প্রতি তিনিই বলেছেন, আগামী নির্বাচিত সরকার পে কমিশন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থ উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পরই কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারই পে কমিশন গঠন করেছে, তাই নতুন পে-স্কেলও এই সরকারকেই দিতে হবে। নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে সুপারিশ জমা না পড়লে কমিশনের ওপর চাপ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণেরও ইঙ্গিত দেন এই কর্মচারী নেতা।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশে নতুন পে স্কেল করার সময় রীতিমতো হইচই শুরু হয়, এটা একেবারে ভিত্তিহীনও নয়। সরকার পে স্কেল দিলেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এতে বেসরকারিসহ অন্যান্য খাতের কর্মীরা বিপদে পড়েন। ফলে সব মহলেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলে।
আবার পে স্কেল অনেক দিন ধরেই দেওয়া হচ্ছে না। তার পরও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দেশের কর–জিডিপির অনুপাত কম। গত ১৭ বছরে জিডিপির আকার বড় হলেও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমও কিছুটা স্তিমিত, প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ফলে রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পে স্কেল গঠনের ভার নতুন সরকারের ওপর দিতে চায়।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সর্বশেষ পে কমিশন হয়েছিল ২০১৫ সালে। এরপর তাদের বছরে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। তবে তারা একই বেতন স্কেলে প্রায় ১০ বছর চাকরি করছেন। ফলে তাদেরও বেতন বৃদ্ধি দরকার, এ নিয়ে কথা থাকতে পারে না। আবার শুধু বেতন বাড়িয়েই জনজীবনে স্বস্তি ফেরানো যাবে না। এ জন্য রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। সরকারি–বেসরকারি খাতের ব্যবধানও কমাতে হবে বলে অনেকে মনে করছেন।
এরইমধ্যে গত ১৪ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারি দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ। এ সময় নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ এবং ১ জানুয়ারি থেকে নবম পে স্কেল কার্যকর করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর না হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও হুমকি দেন কর্মচারী নেতারা।
বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের সেক্রেটারি খায়ের আহমেদ মজুমদার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নতুন পে স্কেলের দাবিতে সব কর্মচারী সংগঠনকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার জন্য আলোচনা চলমান। ইতোমধ্যে কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের নেতৃত্বে ১২ টি কর্মচারী সংগঠন এই দাবিতে আন্দোলনের জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের ছয়টি সংগঠন, ১১-২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরাম, বাংলাদেশ কর্মচারী উন্নয়ন ফোরাম, ১৭-২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী সমিতি, দপ্তরি কাম প্রহরীদের সংগঠন, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগ। এছাড়া সরকারি গাড়িচালকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পে স্কেল কার্যকরের গেজেট না হলে কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিতে যাবেন কর্মচারীরা, এমন ইঙ্গিত দিয়ে এই কর্মচারী নেতা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমাদের দেয়া সময়সীমার মধ্যে যদি দাবি মানা না হয়, তাহলে দাবি আদায়ে যেকোনো কর্মসূচি দিতে পিছপা হব না।’
১১-২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কর্মচারীদের সব সংগঠনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক চলমান। বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি মেনে না নেয়া হলে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ, ঢাকায় মহা-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি এবং কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি আসতে পারে।’
যেকোনভাবেই হোক, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন পে স্কেলের গেজেট দেখতে চায় কর্মচারীরা, এমন মন্তব্য করে কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের মুখপাত্র আব্দুল মালেক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘একটা আস্থার জায়গা প্রয়োজন। ডিসেম্বরে নতুন পে স্কেলের গেজেট হলে কর্মচারীরা আশ্বস্ত হবেন। সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন স্কেল দিতে পারে। আগামী অর্থবছরে ছয় মাসের এরিয়া দিয়ে দিতে পারেন। তবে নতুন পে স্কেল অবশ্যই দিতে হবে।’