একাই লড়াই করে চলেছেন রুনা আক্তার। দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে যাচ্ছেন পোস্টার। রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করেছিলেন। এর পর পুরান ঢাকার আদালত এলাকা, তাঁতীবাজার ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের আশপাশে লাগিয়েছেন পোস্টার।
না, এটি কোনো নির্বাচনী প্রচারণা নয়। ১৫ বছরের একমাত্র সন্তান রোমান দেওয়ানের খুনিদের বিচার চেয়ে মা রুনা যেন এঁকে চলেছেন প্রতিবাদের দেয়ালচিত্র। তাঁর পোস্টারে লেখা– ‘রোমান হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই’।
গত ১৯ অক্টোবর রাতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বয়েজ ক্লাব-সংলগ্ন এলাকায় খুন হয় রোমান। দরিদ্রতা আর দুঃখের বেড়াজালে আচ্ছন্ন জীবনে রোমান ছিল মায়ের বেঁচে থাকার বড় প্রেরণা।
পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাবে, গত অক্টোবরে সারাদেশে ৩১৯টি হত্যার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ১০ মাসে শুধু রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ২০টি হত্যার ঘটনা ঘটে।
স্বামীর সঙ্গে রুনা আক্তারের বিচ্ছেদ হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এরপর বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে রুনা থাকতেন কেরানীগঞ্জের আগানগরের নামাপাড়ায়। তাঁর বাবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তবে সবসময় হাতে কাজ থাকে না।
পরিবারের অভাব দেখে রোমান পড়াশোনা বন্ধ করে পোশাকের কারখানায় প্রিন্টের কাজ করত। সপ্তাহে এক হাজার ৫০০ টাকা ছিল তার বেতন। হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে প্রথম সপ্তাহের বেতন পেয়ে মাকে ৫০০ টাকা ও দাদিকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা নিজে রাখে।
মা রুনা আক্তার সমকালকে জানান, টিকটকের সামান্য একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে ছেলেকে হারাতে হয়েছে। মাস তিনেক আগে রোমানের এক খালা কেরানীগঞ্জে তাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। তখন রোমান বাসার ছাদে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একটি ভিডিও তৈরি করে। সেটি টিকটকে নিজের একাউন্ট থেকে পোস্ট করে। ওই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর পর রোমানের পরিচিত একই এলাকার রিফাত সেখানে বাজে মন্তব্য করে। এর পর রোমান মন্তব্য করে– কারো পরিচয় না জেনে পোস্টে বাজে কিছু লেখা ঠিক নয়। এ নিয়ে রোমান ও রিফাত পাল্টাপাল্টি ভিডিও তৈরি করে পোস্ট করতে থাকে।
রুনা আক্তার জানান, ঘটনার রাতে কাজ শেষে দাদির বাসায় যাচ্ছিল রোমান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে রিফাতসহ কয়েকজন কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ বয়েজ ক্লাব-সংলগ্ন এলাকায় তার গতিরোধ করে। এরপর ছুরিকাঘাত করে রাস্তার পাশে ফেলে যায় তাকে। রক্তাক্ত অবস্থায় প্রথমে রোমানকে নেওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। পরে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
নিহতের পরিবার এবং সুরতহাল প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোমানের বুকে কলম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ডান পায়ে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এতে তার মৃত্যু হয়।
ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো রুনা আক্তার। বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একজনমাত্র আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যরা ধরা পড়েনি। প্রশাসন যাতে আসামিদের ধরে তাই ঘুরে ঘুরে পোস্টার লাগাচ্ছি। আসামিদের যেসব জায়গায় বাসা, কেরানীগঞ্জের এমন সব এলাকায় পোস্টার লাগানো শেষ হয়েছে। তবে কারা যেন রাতের আঁধারে কিছু পোস্টার ছিঁড়েও ফেলেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব। পরিচিত লোকজন ও ছেলের বন্ধুদের কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে পোস্টার ছাপিয়েছি।’ পোস্টারে একাধিক আসামির ছবি দেওয়া হয়েছে।
রোমানের মা আরও বলেন, ‘কাতার ও দুবাইয়ে ৫ বছর কাজ করেছি। টাকা রোজগার করে ছেলের বাবার কাছে পাঠাতাম। এখন সেই সংসার নেই। নিঃস্ব অবস্থা আমার। বৃদ্ধ মা-বাবার সংসারে বোঝা হয়ে আছি। ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল। তাও শেষ হয়ে গেল।’
হতভাগা এই মা বলেন, ‘প্রথম সপ্তাহের বেতন হাতে নিয়ে রোমান বলছিল, মা, আমাদের খারাপ সময় কেটে যাবে। কিন্তু সামান্য ঘটনা নিয়ে তারা আমার ছেলের জীবন নিয়ে টান দেবে– বুঝতে পারিনি। খুনিদের বিচার চাই আমি। এর জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ব। আমার আর হারাবার কিছু নেই।’
রুনা আক্তার জানান, রোমানের বাবা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে। এসব নিয়ে তার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এরপর আর সংসার টেকেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ইবনে ফরহাদ গতকাল সন্ধ্যায় সমকালকে বলেন, রিফাত নামে এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে। আরও কিছু শিশু-কিশোরের নাম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দুজন তরুণের নামও পাচ্ছি। তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। তিনিও জানান, টিকটকের ভিডিও নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড হয়।
এত দিনেও কেন অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি– জানতে চাইলে ইবনে ফরহাদ বলেন, দুই তরুণকে গ্রেপ্তারে আমরা জোর দিচ্ছি। তাদের অন্তত একজনকে ধরা গেলে অন্যদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার রিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য নেওয়া হয়েছে। সে বলেছে, রোমানের বুকে কলম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডান পায়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় আরও চারজন ছিল বলে জানায় রিফাত। তবে একই রাতে আরেকটি কিশোর গ্রুপ রোমানের আরেক বন্ধুকে মারধর করে। সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাত ১০টার দিকে রুনা আক্তার সমকালকে জানান, ‘গত এক মাসে পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হঠাৎ রাতে তদন্ত কর্মকর্তা ফোন করে বলেছেন, দ্রুত আসামিরা ধরা পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে দুবার পুলিশের সঙ্গে দেখা করেছি আমি। তারা আমার কাছে অভিযুক্তদের মোবাইল নম্বর চেয়েছেন।’