Image description

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার দিন শেষ হওয়ার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, এক বছরেরও বেশি সময় পর সেই বিশ্বাস এখন প্রশ্নের মুখে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় বসে দেশে ন্যায়বিচার, সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতার অবসানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছর ঘুরতেই সেই প্রতিশ্রুতি ফিকে হতে শুরু করেছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নতুন এক প্রতিবেদন অনুসারে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১৪ মাসে (আগস্ট ২০২৪ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫) কমপক্ষে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। খবর কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরার।

অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও আগের শাসনামলের তুলনায় হত্যার সংখ্যা কমেছে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও পিটুনিতে হত্যাসহ যেসব পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা পূর্ববর্তী সরকারের ভীতিকর পদ্ধতির কথা মনে করিয়ে দেয়। গড়ে প্রতি মাসে তিনটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটলেও, সর্বশেষ প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) নিহত হয়েছেন ১১ জন, যা এই প্রবণতার অবনতি নির্দেশ করে।  

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে কয়েকটি উদাহারণ তুলে ধরে। তার মধ্যে ঢাকার মিরপুরে যুবদল নেতা আসিফ শিকদারকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করা হয়, যেখানে মৃত্যুসনদে অজ্ঞান অবস্থায় আনা হয় লেখা ছিল। অন্যদিকে কুমিল্লার ইটলা গ্রামে আটক আরেক যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়ার পর জনক্ষোভের মুখে সেনা কর্তৃপক্ষ তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এসব মৃত্যুর ঘটনায় দায়মুক্তির চিহ্ন স্পষ্ট। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার অস্বীকৃতি এবং বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের অনুপস্থিতি দেখা গেছে। নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী, ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক ব্যক্তি, অভিযুক্ত অপরাধী এবং নিরাপত্তা অভিযানে ধরা পড়া নাগরিকরা ছিলেন। তবে পুলিশ সদর দপ্তর পদ্ধতিগত অপব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, হেফাজতে বা অভিযানে মৃত্যু নিয়ে তদন্ত চলছে।
অধিকারের অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন পরিচালক তাসকিন ফাহমিনা আল জাজিরাকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা উদ্বেগজনক হলেও পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত নয়। তিনি এর কারণ হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরতদের মধ্যে পুরোনো ব্যবস্থার উত্তরাধিকার অক্ষুণ্ণ থাকাকে দায়ী করেন। 

তিনি আরও বলেন, হাসিনার অধীনে হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল পদ্ধতিগত এবং উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশিত। তবে বর্তমান সরকারে গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়নি, যা একটি ইতিবাচক দিক। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফাহমিনা বলেন, সেনাবাহিনী বেসামরিক আইন প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষিত নয় এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য মোতায়েন তাদের শৃঙ্খলাকে প্রভাবিত করেছে।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে, এই সরকারের সময়ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশ কোনো অর্থপূর্ণ সংস্কার বা নজরদারি ছাড়াই কাজ করে চলেছে। 

এদিকে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েও আল জাজিরা ড. ইউনূসের মিডিয়া উইংয়ের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পায়নি বলে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারই কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের সমাধান করতে পারে। তবে তাসকিন ফাহমিনা বলেন, প্রকৃত পরীক্ষা হবে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তখন সংস্কার, নাকি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি—এর ওপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ।

অনুবাদ: শিব্বীর আহমদ রেজা

আরটিভি