বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব নিয়ে সমালোচনা করে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় একাধিকবার চেষ্টা করেও ভারত কখনোই হেজেমনিক (প্রভুত্ববাদী) রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি, শুধুমাত্র শেখ হাসিনার সরকার ও ভুটান ছাড়া কোনো দেশই ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি।
শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে রোজ একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলায় মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ইন্দিরা গান্ধী একসময় বলেছিলেন- দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারত সেই হেজেমনিক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ ও ভুটানের ওপর ভারতের কিছুটা প্রভাব রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ কিংবা আফগানিস্তান- কোনো দেশই ভারতের কথায় চলে না।
তিনি বলেন, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ায় ভারত তাকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নেপালে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ভারত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় সামরিক হস্তক্ষেপের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ভারত লঙ্কান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। মালদ্বীপ থেকেও ভারতীয় প্রভাব হটিয়ে দিয়েছে স্থানীয়রা।
মাহমুদুর রহমান বলেন, হাসিনা সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশের ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। একইভাবে ভুটানের ওপরও ভারতের পূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। এই দুটি দেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার কোনো রাষ্ট্র ভারতের হেজেমনিকে স্বীকার করেনি।
রাজনৈতিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলোকে আমি পাঁচ ভাগে ভাগ করি- লিডার, হেজেমন, ডমিনেটর, ডিচ পাওয়ার ও পটেনশিয়াল পাওয়ার।
আমার দেশ সম্পাদক বলেন, লিডার সেই রাষ্ট্র, যে নিজের শক্তিকে ব্যবহার করে অন্যদের উন্নতিতে সহায়তা করে। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল আফ্রিকার লিডার; সে কখনো কোনো দেশের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করেনি। অন্যদিকে হেজেমন হলো সেই রাষ্ট্র, যে তার অঞ্চলের অন্য দেশগুলিকে নিজের অধীনে রাখতে চায়- ইন্দিরা গান্ধীর আমলের ভারত তার উদাহরণ। আর ডমিনেটর রাষ্ট্র হলো সে, যে নিজের ইচ্ছার বাইরে কেউ গেলেই তাকে ধ্বংস করে দেয়। ইসরাইল এর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ।
ইন্দোনেশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ, কিন্তু বৈশ্বিক কোনো বিষয়ে তাদের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না- এটা তাদের ডিচ অ্যাটিটিউড তৈরি করেছে। অন্যদিকে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে তিনি ‘পটেনশিয়াল পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ‘তাদের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে একদিন তারা বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট টেনে ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, রোমান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর প্রথম বড় সাম্রাজ্য, এরপর ১৯শ শতকে ব্রিটিশরা সবচেয়ে বৃহৎ কলোনিয়াল এম্পায়ার গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই উপনিবেশবাদ ভেঙে পড়ে কিন্তু অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে জন্ম নেয় ‘নিও-কলোনিয়ালিজম’।
তিনি বলেন, আমরা আজ আমেরিকান সাম্রাজ্যের ছায়াতলে বাস করছি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি দেশ দখল করে না, তবু তার অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবই পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
মাহমুদুর রহমান আরও উল্লেখ করেন, বর্তমানে আমরা ইউনিপোলার বিশ্বে বাস করছি, যা মার্কিন নেতৃত্বে চলছে। তবে চীনের উত্থানের ফলে আগামী ৫০ বছরে নতুন এক বহুমেরু (মাল্টিপোলার) বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।
আলোচনার শেষাংশে তিনি বলেন, ভারত বারবার চেষ্টা করেও দক্ষিণ এশিয়ার নেতা নয় বরং প্রভুত্ববাদী শক্তি হতে চেয়েছে- কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ প্রকৃত নেতা অন্যদের উন্নয়নের অংশীদার করে, প্রভুত্ব কায়েম করে না।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. যুবায়ের মুহাম্মদ এহসানুল হক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আনিসুর রহমান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সঞ্চালনা করেন মাহমুদুল হাসান হাসেমী।