ব্যাংক লুট করেছে একদল প্রভাবশালী। আর এখন এর ভুক্তভোগী ব্যাংকের কর্মীরা। ব্যাংক দেউলিয়ার পথে, এর খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁদের। চাকরি গেছে অনেকের।
আবার কারো কারো চাকরি যাওয়ার পথে। বলা যায়, এটি এখন ব্যাংক খাতে অনেকটা মানবিক বিপর্যয়ের মতো অবস্থা। চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে সৃষ্ট এই মানবিক বিপর্যয় চলছে গত ২০২০ সাল থেকে। করোনার সময় চাকরি স্থিতিশীল রাখার কথা থাকলেও সেই সময় থেকেই শুরু হয় বিশাল পরিসরের ছাঁটাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মহামারি চলাকালে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক তিন হাজার ৩১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে। এর মধ্যেই বেশির ভাগকে ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ করানো হয়। তবে বাস্তবে তা ছিল জোরপূর্বক বিদায়। এই দুর্ভোগ আরো তীব্র হয় সরকার পরিবর্তনের পর।
বিভিন্ন ব্যাংকে যোগ্যতা যাচাইয়ের নামে শুরু হয় নির্বিচার শুদ্ধি অভিযান যার শিকার হন বহু ব্যাংকার। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন গত তিন মাসে। ইসলামী ধারার আরো কয়েকটি ব্যাংক আল-আরাফাহ ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক—এসব মিলে আরো দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা ছাঁটাই হয়েছেন। সব মিলিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি ব্যাংকার চাকরি হারিয়েছেন। একসময় ব্যাংকের গাড়িতে চড়ে অফিসে যাওয়া মানুষগুলো আজ রিকশা বা হেঁটে চলেন।
সাদা শার্টে টাই পরা ব্যাংকারদের অনেকে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেওয়া তো দূরের কথা, অনেকেই চিকিৎসার খরচও বহন করতে পারছেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মহামারি করোনার সময় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি ছয় ব্যাংকের তিন হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন তিন হাজার ৭০ জন। ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ এবং ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যায়ভাবে বরখাস্তদের পুনর্বহালের নির্দেশ দিলেও কোনো ব্যাংকই তা মানছে না।
সাবেক সিনিয়র অফিসার রফিকুল ইসলাম জানান, মেয়েদের স্কুল ফি দিতে না পারায় স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। স্ত্রীর গয়নাগুলো বিক্রি করে কোনো মতে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আগে যাঁরা ব্যাংক কর্মকর্তাকে দেখে মাথা নত করতেন, এখন তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে (এমটিবি) দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন মাহবুবুর রহমান। শেষদিকে ছিলেন একটি শাখার ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার)। চাকরির সুবাদেই অফিসের গাড়ি, বাসাভাড়া, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা ছিল তাঁর। তিন সন্তানকে পড়াচ্ছিলেন ইংলিশ মিডিয়ামে। সব মিলিয়ে স্থিতিশীল জীবনের স্বপ্নই ছিল তাঁর সামনে।
কিন্তু একদিন হঠাৎই সব ওলটপালট হয়ে যায়। কোনো কারণ না জানিয়ে মাহবুবকে জানানো হয় তাঁকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগ না করলে সার্ভিস বেনিফিটও দেওয়া হবে না বলে ইঙ্গিত পান তিনি। পরিবারের ভবিষ্যৎ ও শেষ সম্বল হারানোর আতঙ্কে অবশেষে ২০২০ সালের জুনে বাধ্য হয়ে পদত্যাগপত্রে সই করেন।
মাহবুবুর রহমান আজ তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ, সংসারের নিত্য চাহিদা কিছুই ঠিকমতো মেটাতে পারছেন না। যে মানুষটি একসময় গাড়িতে করে অফিসে যেতেন, এখন তাঁকে হেঁটে চলা চাকরিহারা একজন সাবেক ব্যাংকার বলেই জানে সবাই। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছোট হতে হতে তাঁর জীবন ক্রমেই গুটিয়ে গেছে।
তাঁর দাবি, করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা যাবে না। কিন্তু সেই নির্দেশনা ঢাকাই রইল ব্যাংকগুলোর কাছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা তো আগেই ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। এর পর ওই বিষয়টা এখন আদালতে বিচারাধীন। আদালত একটি রুলও দিয়েছিলেন। এখন পুরো বিষয়টি আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন। যদি কোনো ব্যাংক সেই নির্দেশনা না মানে তাহলে সেটা আইনিভাবেই সমাধান করতে হবে চাকরিহারা কর্মকর্তাদের।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দক্ষ ব্যাংকারদের এভাবে বাদ দেওয়া শুধু মানবিক ক্ষতি নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর। যাঁরা একসময় দেশের অর্থনীতির চাকায় তেল দিতেন, এখন সেই চাকাতেই পিষ্ট হচ্ছেন তাঁরা।
প্রসঙ্গত, পাঁচ ব্যাংক মার্জ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকেই দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতে ব্যাপক ছাঁটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন।
পাওয়া তথ্য মতে, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে মোট দুই হাজার ২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু আল-আরাফাহ ব্যাংক থেকেই ৫৫০ জন কর্মকর্তা চাকরি হারান।
গত নভেম্বরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসির ২৬২ জন কর্মকর্তা, এসআইবিএলে এস আলম গ্রুপের আমলে নিয়োগ পাওয়া ৫৭৯ কর্মকর্তা এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৫৪৫ জন কর্মকর্তা চাকরি হারান।
অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনেক ব্যাংক অনুমোদন পায় এবং সেখানে নিয়ম না মেনে অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন নতুন পরিচালনা পর্ষদ যোগ্যতা যাচাইয়ের নামে পরীক্ষা নিচ্ছে, যেখানে অনেক কর্মকর্তা ব্যর্থ হয়েছেন।