সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘সরল বিশ্বাসে’ সংঘটিত দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে আর কোনও অনুমতির প্রয়োজন হবে না দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। তবে সংস্কার কমিশনের দেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশই উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদিত সংশোধিত অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দুদকের নতুন এই অধ্যাদেশে কমিশনের সদস্য সংখ্যা, পদায়ন প্রক্রিয়া এবং ঊর্ধ্বতন পদে দুদক কর্মকর্তাদের নিয়োগে বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কমিশনের অভ্যন্তরেও চলছে নানামুখী আলোচনা। অপরদিকে, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, কমিশনের দেওয়া বেশ কিছু প্রস্তাব চূড়ান্ত খসড়ায় স্থান না পাওয়ায় তারা হতাশ। তাদের মতে, প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে কমিশনের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী হতো।
২০১৩ সালের দুদক (সংশোধন) আইনের পর থেকে কোনও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু করতে হলে সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি নিতে হতো। যার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুরুতেই অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম থেমে যেতো। অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হতো মসের পর মাস। এতে অনেক তথ্য-প্রমাণই আর পাওয়া যায় না।
গত ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত অনুমোদন পাওয়া খসড়াটিতে বলা হয়েছে— ‘দুদক আইন-২০০৪’ এর ৩২ (ক) ধারা বাতিল করা হবে। এই ধারায় বলা হয়েছিল, বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুসরণ করতে হবে। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনও জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা তার দাফতরিক দায়িত্ব পালনের সময় কোনও অপরাধ করেছেন মর্মে অভিযোগ উঠলে, সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনও আদালত সেই অভিযোগ আমলে নিতে পারবে না। সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়, সংসদীয় কমিটির আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৩ সালে তখনকার সরকার ৩২ (ক) ধারা দুদক আইনে যুক্ত করেছিল— যা ছিল ‘বৈষম্যমূলক’। একইসঙ্গে কমিশনের স্বাধীনতাকেও খর্ব করা হয়। ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত এই ধারাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এবং সেটি বাতিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই আদেশ বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ (টিআইবি) দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্টরাও এই বিধান বাতিলের দাবি করে আসছিলেন শুরু থেকেই।
দুর্নীতিবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিধান বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ, এটি দুদকের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করছিল। নতুন অধ্যাদেশে এই বিধান বাতিলের মাধ্যমে দুদক সংস্কার কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। যেটাকে ইতিবাচক ও ভালো দিক বলে মন্তব্য করেন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে পূর্বানুমতির যে দুদক আইন ছিল, সেটা বাতিল করা হয়েছে। এটা একটা ভালো দিক। এখন আর তাদের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। যদি না সরকার নতুন করে অন্য কিছু আবিষ্কার না করে।’’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘‘হতাশার দিক হচ্ছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অধ্যাদেশ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যে অধ্যাদেশে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আশু কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়নি। সংশোধিত নতুন অধ্যাদেশে অনেকগুলো দুর্বলতা থাকার কারণে হতাশা আরও বেশি বেড়ে গেলো।’
তিনি বলেন, ‘‘খসড়া অধ্যাদেশটি বিদ্যমান আইনের চেয়ে কিছুটা উন্নত সংস্করণ। এতে দুদক সংস্কার কমিশনের কোনও কোনও সুপারিশের প্রতিফলন ঘটেছে। তবে সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, যা হতাশাজনক।’’ টিআইবির পরিচালক আরও বলেন, ‘‘যে কারণে জন্মলগ্ন থেকে দুদক ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা আর প্রতিপক্ষের হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, সরকার সে অবস্থার পরিবর্তন চাইছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকার পরও ‘সিলেকশন অ্যান্ড রিভিউ কমিটি’, ছয় মাস পরপর কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের প্রস্তাব এবং ‘কমিশনারের সংখ্যা তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন করার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে।’’
দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘বর্তমানে দুদক অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়ায় ৩২ (ক) ধারাটি বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে দুদক এখন সরকারের পূ্র্বানুমতি ছাড়াই সরাসরি যেকোনও অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা করতে পারবে।’’