Mahbubur Razzaque
( ডঃ মাহবুবুর রাজ্জাক ) অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট।
ঈশপের গল্পগুলো সাধারণত ছোট ও মজার। তার গল্পের প্রাণীরা কথা বলতে পারতো। সেই ঈশপের একটি নীতিগল্প বা ফেবলস এই রকম - একদিন এক কাক গাছের ডালে বসে ছিল। তার ঠোঁটে ছিল এক টুকরো পনির। ঠিক তখন এক ধূর্ত শিয়াল নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। কাকের ঠোঁটে পনিরটা দেখে তার জিভে জল আসলো। ভাবল, “এই পনিরটা যদি কোনোভাবে পাওয়া যেত!” তাই সে বুদ্ধি খাটাল। শিয়াল মিষ্টি গলায় বলল, “ওহে সুন্দর কাক! তোমার পালক কত চকচকে, দেখতে কত রাজসিক! নিশ্চয়ই তোমার গলা খুব সুমধুর। আমায় একটু গান শোনাও না ভাই!” কাক মনে মনে খুশি হয়ে গেল। সে ভাবল, “আমার গান শুনতে চায়! আমি তো সত্যিই প্রতিভাবান!” তাই সে মুখ খুলে গান গাইতে গেল। আর সাথে সাথে পনিরটা পড়ে গেল নিচে! শিয়াল সেটা মুখে নিয়ে হেসে বলল, “ধন্যবাদ, মিষ্টি কণ্ঠের কাক! তোমার গানটা বেশ মধুর, কিন্তু বুদ্ধিটা কম!” এ কথা বলেই সে পনির নিয়ে পালাল। কাক বুঝতে পারল ভুল হয়ে গেছে; তাই লজ্জায় মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। চাটুকারের কথায় ভুলতে হয় না। অতি প্রশংসা অনেক সময় প্রতারণার ফাঁদ হয়ে দেখা দেয়।
ঈশপের গল্পের কাক আর শিয়াল কোন দেশের ছিলো জানা নাই। তবে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত বুয়েটের শিক্ষকদের অবস্থা ঈশপের গল্পের কাকের মতই। মেধাবী শব্দটি শুনলেই তাঁরা হা করে ফেলেন, আর পনির নিয়ে যায় অন্যরা। বুয়েটের একটা সুনাম আছে বটে; তবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার তেমন কোন গল্প আজো তৈরি হয় নাই। এখানে ভর্তি পরীক্ষাটা নিরপেক্ষভাবে হয়। ক্লাস ও পরীক্ষাগুলো যথাযথভাবে হয়। মেধার পরীক্ষায় প্রথম দিককার ছাত্ররা এখানে পড়াশোনা করে। এলামনাইরা বিশ্বের সেরা জায়গাগুলোতে চাকুরী করে। ব্যস! এতটুকুই। এত্থেকেই বুয়েটের একটি হাওয়াই ইমেজ তৈরি হয়েছে। বুয়েট হলো সকল কাজের কাজি। তাই এই দেশে বড় প্রজেক্টে বুয়েটকে মাঝে মাঝে ডাকা হয় শুধুমাত্র এই ইমেজটা ব্যবহার করার জন্য; কাজের কাজ করার জন্য নয়। আসলে বুয়েটের সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে এই দেশের কর্তাব্যক্তিদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। বুয়েটে যারা চেয়ারে বসে আছেন তাদের আগ্রহ আছে কিনা সেটিও পরিষ্কার নয়। বুয়েট দেশের সেরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – এই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুরোধে বুয়েট শিক্ষকদের এমন সব কাজে নিয়োজিত করা হয়, যা করার জন্য তাদের মত মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তারপরেও বুয়েট শিক্ষকেরা ঈশপের গল্পের সেই কাকের গান গাওয়ার মত বছরের পর বছর ধরে সেইসব কাজ করে চলেছেন। অথচ দেশের প্রকৌশল খাতের প্রকৃত সম্বৃদ্ধির জন্য তাদের মেধা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে না।
দেশের প্রযুক্তি খাতে শত শত ঘটনা ঘটে যায়, বুয়েটসহ স্থানীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়না। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই তাদের ডাক পড়ে। বাংলাদেশের প্রকৌশল খাতের অবস্থা অনেকটা সেই হাসপাতালের মত যেখানে ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগীটি মরিয়া যায়’। ডাক্তার যখন আসে তখন কিছুই করার উপায় থাকেনা। হাজার হাজার কোটি টাকার মেট্রো রেল প্রজেক্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট (বি আর টি) প্রজেক্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। বুয়েটকে ডাকা সম্ভব না হলে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদেরও সংযুক্ত করা যায়, সেটিও করা হয় না। বিদেশি পরামর্শক, বিদেশি কন্ট্রাক্টর কাজে অভিজ্ঞ হতে পারে। কিন্তু তাদের কাজ ঠিকমত সুপারভিশন করা না হলে ত্রুটি থাকবেই। এর খেসারত দিচ্ছে জাতি। ফলে আমরা দেখছি, মেট্রো রেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ বি আর টি প্রজেক্টটিই মুখ থুবড়ে পরেছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট আমরা নিরাপদে পরিচালনা করতে পারব কিনা তা’ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে বুয়েট শিক্ষকদের দিয়ে যে অকাজের কাজগুলো করিয়ে নেয়া হয় তার একটা হলো বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুসারে দরপত্র মূল্যায়ন করা। বুয়েটের শিক্ষকরা প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ নন। তাদের ডাকা হয় শুধুমাত্র তাদের উচ্চ নৈতিক অবস্থানের কারনে। ক্রয় প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সাথে সম্পন্ন হবে এই আশায়। এই কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের ডাকা দরকার নেই, ডাকা দরকার সৎ প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞদের। যখন জাতীয় পর্যায়ের কোন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই সমীক্ষা হয় বা বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয় কিংবা দরপত্রের শর্তাদি প্রস্তুত করা হয় তখন যদি কমিটিতে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে কারিগরি বিষয় নিয়ে মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে। ভালো অবদান রাখার সুযোগ থাকে। মজার ব্যাপার হলো তখন তাদের ডাকা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নাই বললেই চলে। ডাকা হয় একদম শেষ মুহুর্তে দরপত্র মূল্যায়নের সময়, যখন কারিগরিভাবে অবদান রাখার কোন সুযোগ থাকে না।
বুয়েট শিক্ষকদের দিয়ে করিয়ে নেয়া এমনই আরেকটি অকাজ হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনা করা। প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, মেধা তালিকা তৈরি করা – এই কাজগুলোতে বুয়েটের সততার দীর্ঘদিনের সুনাম থাকলেও প্রকৌশল চর্চার সাথে এর সম্পর্ক নাই বললেই চলে। অথচ বুয়েটের প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ শিক্ষক আর কর্মকর্তা ছুটির দিনগুলো নষ্ট করেন নিয়োগ পরীক্ষার তদারকি করে। শিক্ষকেরা তাদের সুন্দর বিকেল গুলো পার করে দেন এই সমস্ত খাতা দেখে দেখে। এই কাজগুলোতে যেই সামান্য আয় হয়, সেই পরিমাণ আয় গবেষণা থেকে হয় না, পেশাগত বিশেষজ্ঞ সেবা দিয়ে হয় না। কাজেই বুয়েটের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণ আয় কমে যাবার ভয়ে কাজ ছাড়তে পারেন না। মেধার অপচয়ের এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর হয়না।
এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। দেশের বড় বড় প্রজেক্টগুলো ‘মরিয়া যাওয়ার পূর্বেই’ যাতে ডাক্তারের দেখা পায় সেই ব্যবস্থা করা দরকার। বুয়েটসহ সরকারি বেসরকারি খাতের যোগ্যতা সম্পন্ন প্রকৌশলীদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রজেক্টে সম্ভাব্যতা যাঁচাইয়ের পর্ব থেকেই বাধ্যতামূলকভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে প্রবাসী বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এতে প্রজেক্টের ব্যয় সামান্য বাড়লেও দেশ দুইভাবে উপকৃত হবে। প্রথমত, দেশের পক্ষ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য যোগ্য জনবল থাক
আমাদের দেশে কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনায় সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ তাদের অনেকেরই প্রাথমিক পর্যায়ের কারিগরি জ্ঞানও থাকে না। দিনদিন প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়, প্রজেক্টের জটিলতা বাড়ে। ব্যবস্থাপনার জটিলতাও বাড়ে। কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনা সাধারণ ব্যবস্থাপনা থেকে ভিন্ন। তাই কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনার শীর্ষ পর্যায়ে লাগসই কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করা না হলে সুপারভিশন ভালো হবে না। প্রজেক্ট শেষে নানা রকম কারিগরি ত্রুটি বের হয়ে আসবে; অথচ তখন কিছুই করার থাকবে না। কাজেই, এখন থেকে নিয়ম করা উচিৎ যাতে সকল কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনার শীর্ষ পর্যায়ে যথাযথ কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করা হয়। দেশে এত শত শত প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও কোন ক্ষেত্রেই আমাদের কার্যকর সক্ষমতা তৈরি না হওয়াটা দুঃখজনক। এই দুর্ণাম যত তাড়াতাড়ি ঘুচবে দেশ হিসেবে ততই আমরা এগিয়ে যাব।
[বুয়েট ক্যাম্পাসঃ ২৮ অক্টোবর, ২০২৫]