২৯ বছর পর সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘হত্যা’ হিসেবে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এই প্রেক্ষাপটে সিডনিতে প্রথম আলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় মুখ খুললেন তাঁর সর্বাধিক ছবির নায়িকা শাবনূর। বললেন, ‘আমাকে কেন দোষারোপ করা হচ্ছে? আমিও বিচার চাই।’
ঢাকাই চলচ্চিত্রের আকাশে যেন ধূমকেতুর মতো এসেছিলেন সালমান শাহ। মাত্র চার বছরের অভিনয়জীবনে বদলে দিয়েছিলেন বাণিজ্যিক সিনেমার চেহারা, দর্শকের রুচি ও তরুণ প্রজন্মের নায়ক ধারণা। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁর আকস্মিক মৃত্যু যেন পুরো জাতিকেই হতভম্ব করে দিয়েছিল। সেদিন ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেই মৃত্যুর পর কেটে গেছে দীর্ঘ ২৯ বছর—তবু রহস্যের পর্দা আজও পুরোপুরি ওঠেনি। ২০২৫ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত সালমান শাহর মৃত্যুকে হত্যা হিসেবে গণ্য করে রমনা থানাকে মামলা রুজু ও তদন্তের নির্দেশ দেন। সালমানের মা নীলা চৌধুরীর নারাজি আবেদনের ভিত্তিতেই এই নির্দেশ আসে। পরদিন ২১ অক্টোবর মধ্যরাতে সালমান শাহর মামা মোহাম্মদ আলমগীর বাদী হয়ে রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, লতিফা হক লুছি, খলনায়ক ডনসহ ১১ জনের নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
দৃষ্টি সালমান-শাবনূর জুটি
আদালতের নির্দেশের পর থেকেই তোলপাড় দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আবারও জেগে ওঠে পুরোনো প্রশ্ন, গুজব আর নানা কল্পকাহিনি। স্বাভাবিকভাবেই সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সালমান শাহর সবচেয়ে সফল জুটি—নায়িকা শাবনূরের দিকে। কেননা সালমান-শাবনূর জুটি ছিল নব্বইয়ের দশকের ঢালিউডের সোনালি সময়ের প্রতীক। একসঙ্গে তাঁরা অভিনয় করেছেন ১৪টি ছবিতে—‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘সুজন সখী’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় সিনেমায়। তাঁদের পর্দার রসায়ন ছিল জাদুর মতো, যা এখনো দর্শকের মনে অম্লান।

সিডনি থেকে শাবনূরের প্রতিক্রিয়া
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থানরত শাবনূরের সঙ্গে প্রথম আলোর দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর প্রতিক্রিয়া ও ব্যক্তিগত ক্ষোভ। আলাপের শুরুতেই তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে তিনি আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশের খবর জানতে পেরেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিষয়টি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই আমি মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমার নাম জড়িয়ে যে ভিত্তিহীন গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সালমান শাহ ছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় সহ-অভিনেতা। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তার সঙ্গে কাজ করেই আমার চলচ্চিত্রজীবন বিকশিত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমাদের জুটির সাফল্য একসময় অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মৃত্যুর পর কেউ কেউ হয়তো নিজেদের বাঁচাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার সঙ্গে সালমানের সম্পর্ক নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়িয়েছে।’
‘আমার সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই মিথ্যা’
আনুষ্ঠানিক বিবৃতির চেয়েও টেলিফোনে আলাপচারিতায় শাবনূরের কণ্ঠে ছিল আরও বেশি আবেগ, হতাশা ও ক্ষোভ। কিছুটা উত্তেজিত স্বরেই তিনি বলেন, ‘এটা খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। আমার সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই মিথ্যা, সব বানোয়াট কথা। আমি বুঝি না কেন এখনো আমাকে এই ঘটনায় টেনে আনা হচ্ছে। আমি তো কিছুই জানি না। আমি তখন ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তাহলে কেন এই ভিত্তিহীন কথা? আমাকে কেন অকারণে দোষারোপ করা হচ্ছে?’ শাবনূর স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ঘটনার আগের দিনও তো সালমান ও সামিরা (সালমানের স্ত্রী) হাসিখুশি ছিল। ওরা ডাবিং থিয়েটার থেকে একসঙ্গেই হাসতে হাসতে বের হয়েছে। এটা আমার কথা নয়, আমাদের পরিচালক, ইউনিটের অনেকেই তা দেখেছে।’

‘আমিও এখন বিচার চাই’
দীর্ঘ সময় ধরে নানা অপপ্রচার ও গুজব তাঁকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করেছে বলে জানান শাবনূর। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই এখন বিচার চাই। আমাকে নিয়ে যে নোংরামি হচ্ছে, আমি তার বিচার চাই। কী এমন হয়েছিল যে এক রাতেই সব শেষ হয়ে গেল? যারা ওই সময় ওর (সালমানের) সঙ্গে ছিল, তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আমরা তো পর্দার মানুষ, আমরা তো তৃতীয় পক্ষ। পর্দার রসায়ন আর বাস্তব জীবন এক নয়।’ তিনি সালমানের স্ত্রী সামিরার বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারের অসংগতির কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, ‘অনেক সময় আমি অবাক হয়ে শুনি, কীভাবে সেই সময়ের অনেক তথ্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমার তখন বয়স কত ছিল? আমি তো আমার পরিবারের অনুমতি ছাড়া কোথাও যেতেই পারতাম না। আমার কাজ, চলাফেরা—সবকিছুই আমার পরিবার ও প্রযোজনা সংস্থার তত্ত্বাবধানে ছিল।’
বিতর্কের ভারে ক্লান্ত শাবনূর
দীর্ঘ ২৯ বছরের এই বিতর্কের ভার বয়ে চলা জীবনের এক যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় বলে উল্লেখ করেন শাবনূর। তিনি বলেন, ‘এই সময়টা আমাকে ভেতর থেকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। আমি নিজের মতো করে সংসার করছি, সন্তান ও পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই। কিন্তু যখনই এ বিষয়টা নতুন করে আলোচনায় আসে, মনে হয় আমি আবার সেই পুরোনো অন্ধকার সময়ের দিকে ফিরে যাচ্ছি।’বর্তমানে সিডনিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন শাবনূর। একমাত্র সন্তান ও পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে চান। সালমান শাহর মৃত্যুর বিচার নিয়ে তাঁর কণ্ঠে একটাই আহ্বান—ন্যায়বিচার। বলেন, ‘জনগণ যেমন বিচার চায়, সালমান ভাইয়ের মা (নীলা আন্টি) যেমন সন্তানের বিচার চান, আমিও তেমনই এই মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। যে-ই দোষী হোক না কেন, তাকে যেন আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হয়।’

এ রহস্যের অবসান হবে কবে
সালমান শাহর মৃত্যু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়গুলোর একটি। তিন দশক পেরিয়ে গেলেও সেই রহস্যের সমাধান হয়নি। সময়ের সঙ্গে বদলেছে প্রজন্ম, কিন্তু ‘সালমান শাহ’ নামটি এখনো আবেগ, স্মৃতি আর কৌতূহলের আরেক নাম। শাবনূরের কণ্ঠে তাই একটাই প্রত্যাশা—‘সত্যটা যেন বেরিয়ে আসে, ন্যায়বিচার যেন হয় এবং এই অন্তহীন বিতর্ক যেন অবশেষে শেষ হয়।’