Image description
দেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড

দেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চারদিকে শোরগোল। সর্বশেষ গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে সবাই। এর আগে ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল কারখানা আগুনে পুড়েছে। ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানার আগুনে তরতাজা ১৬টি প্রাণ অঙ্গার হয়েছে।

চলতি মাসে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা নাকি স্বাভাবিক কোনো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

দেশে মাঝে মধ্যেই ঘটছে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ঝরছে তাজা প্রাণ। নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশায় ভুগছেন অনেকে। ভয়াবহ প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর এর কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এসব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। ফলে দায় নিরূপণ সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর রমনা থানাধীন বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘটিত অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ ও এর প্রতিকারের উপায় বের করতে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর অন্যতম কারণ কমিটির তদন্তে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা ও জবাবদিহি না থাকার বিষয়টি উঠে আসে।

উচ্চপর্যায়ের ওই কমিটির প্রতিবেদনে দেশের অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ ও প্রাণহানি কমাতে ‘বিট পুলিশিং’-এর বিটকে ভিত্তি করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, বিদ্যুৎ বিভাগসহ মোট দশটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আজও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মাজহারুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটির বিষয়টি আমি আপনার থেকেই নতুন শুনলাম। এমন কোনো কমিটি আছে বলে আমার জানা নেই। রাজধানীর লালবাগ থানা এলাকায় বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ এলাকার জন্যও তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান যুগান্তরকে বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটি’র বিষয়ে আমার জানা নেই।’

অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অনীহার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। অতীতের সরকারগুলো তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কেন বাস্তবায়ন করছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) মোহাম্মাদ মফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি বলতে পারব না। এটার বিষয়ে আমার অথরাইজেশন নেই।’

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপণিবিতান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে গত বছরের ৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ যে কমিটি গঠন করেছিল তাতে পুলিশ, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও ছিলেন। ওই কমিটি ২০১০ সাল থেকে শুরু করে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পর্যন্ত দেশে যত আগুনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে অন্তত ৩১টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে। যার মধ্যে ছিল-২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন (মারা যান ৪৯ জন); ২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মেসার্স হাসেম ফুড লিমিটেডের কারখানার আগুন (মারা যান ৫২ জন); ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুন (মারা যান ২৫ জন); ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রমনা থানাধীন বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবনের আগুন (নারী-শিশুসহ মারা যান ৪৬ জন)। গত বছরের ২০ মে সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। ভয়াবহ ওইসব অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা ও উদাসীনতার বিষয়গুলো তুলে ধরে অগ্নিকাণ্ড রোধে করণীয় বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।

জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাত কারণে মাঝে মধ্যেই দেশে ঘটছে ভয়াবহ ভগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সরকারি-বেসরকারি ১১টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে দেশে অগ্নিঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে মানুষের জানমালের অগ্নিঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের পাশাপাশি স্থানীয় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পরিচালিত পুলিশি কার্যক্রমের ‘বিট পুলিশিং’-এর ‘বিট’কে ভিত্তি ধরে ‘অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটি’ গঠন করতে হবে। ওই কমিটিতে স্থানীয় থানায় সংশ্লিষ্ট বিট অফিসার, স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, রাজউকের প্রতিনিধি, স্থানীয় কাউন্সিলর/সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি/ ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধি, গ্যাস বিভাগের প্রতিনিধি, স্থানীয় আবাসিক সমিতির প্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি, মার্কেট কমিটির সভাপতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়। কমিটির কার্যক্রমের বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।

কমিটির সুপারিশে নিরাপদ গ্যাস সরবরাহের জন্য রেগুলেশন সিস্টেমের ব্যবহারের বিষয়ে বলা হয়েছে, আবাসিক বহুতল ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাট, নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিটি রুম এবং বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এক বা একাধিক সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের পরিবর্তে সেফটি কেবিনেটে গ্যাস সিলিন্ডার সংরক্ষণ করে রেটিকুলেশন সিস্টেমের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। এ বিষয়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া পুকুর ও জলাধার সংরক্ষণের ওপরও জোর দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, পুকুর ও জলাধারগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অগ্নিনির্বাপণ কাজকে ব্যাহত করছে। তাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মহানগর, পৌর ও শিল্পাঞ্চল এলাকার সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ও জলাধারগুলো পরিমাপ ও স্থান উল্লেখ করে একটি অপরিবর্তনীয় কেন্দ্রীয় তালিকা প্রস্তুত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। এই তালিকাভুক্ত পুকুর ও জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পুকুর ও জলাধার সরকার অধিগ্রহণ করবে। এছাড়া এর আগে যেসব চিহ্নিত পুকুর ও জলাধার ভরাট করা হয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আলোচিত অগ্নিকাণ্ডগুলো প্রতিরোধে দায়িত্বরত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট স্থাপনার মালিক ও ব্যবহারকারীদের দায়বদ্ধতার অভাব ছিল। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার, পরিবহণ, সংরক্ষণ, প্রতিস্থাপন ও বিপণনে অজ্ঞতা, অদক্ষতা ও অবহেলা, গ্যাস সরবরাহ লাইন বা পাইপ লিকেজ এবং পয়োবর্জ্যে সৃষ্ট গ্যাস নিষ্কাশন ও নিঃসরণের সুব্যবস্থাপনা না থাকায় অগ্নিকাণ্ডগুলো ঘটছে। এছাড়া আবাসিক জনবহুল ও বাণিজ্যিক এলাকায় রাসায়নিকজাতীয় পদার্থের অনিরাপদ সংরক্ষণ, বিপণন ও ব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে স্বেচ্ছাকৃত কার্যক্রম ও স্থাপনার মালিক ও ব্যবহারকারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অবহেলা এবং গাফিলতির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব পালনে উদাসীনতার কারণে অগ্নিঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি, উন্নয়নকারী সংস্থা (যেমন-রাজউক, চউক, খুউক ইত্যাদি), সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা, গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ওয়াসা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও অগ্নিকাণ্ড রোধে নানা সুপারিশ করা হয়, যার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না। কিছু ক্ষেত্রে আইনের কঠোর বাধ্যবাধকতা থাকায় স্বল্পপরিসরে মানা হচ্ছে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ড রোধে ফায়ার সার্ভিসের অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়ন করে না। আশানুরূপ বাস্তবায়ন হতে আরও সময় লাগবে। মানুষ ফায়ার সেফটির বিষয়ে এখনো সচেতন নয় বলে মনে করেন তিনি।