
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স-এনএসআইয়ের উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশ প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের দায়ের করা সব মামলা ও তাকে হয়রানির কারিগর হিসেবে পরিচিত।
এনএসআইয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে কলকাতা দূতাবাসে কনস্যুলার অ্যাটাচে (দ্বিতীয় সচিব) ছিলেন আমিনুল হক পলাশ । ছাত্র জীবনে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট ছাত্রলীগের আহবায়ক ছিলেন। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাকে কলকাতা দূতাবাসে পাঠানো হয়।
এর আগে এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি টিএম জোবায়ের তাকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার যাবতীয় বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। তিনি এবং এনএসআইয়ের অতিরিক্ত পরিচালক আজিজুর রহমান ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কতসংখ্যক মামলা দেওয়া যায়, কী কী ধরনের মামলা দেওয়া যায়, সাক্ষী এবং অভিযোগকারী কাকে কাকে করা যায়, গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীদের, বিভিন্ন সময়ে চাকরি যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কীভাবে মামলার কাজে, রাজপথে প্রতিবাদের কাজে লাগানো যায়, আইনজীবী কাদের নিয়োগ করা যায়, মামলার উপযুক্ত আর্জি তৈরি করা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ করেন। মামলা হওয়ার পর ওই কর্মকর্তারা ড. ইউনূস যাতে হয়রানির শিকার হন, নির্যাতনের শিকার হন সে জন্য আদালতে লিফট বন্ধ করে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ-ছয় তলায় উঠানো-নামানো, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে ফ্যান চালানো বন্ধ করা ইত্যাদি কাজ করা হতো।
আমিনুল হক পলাশ কলকাতা মিশন থেকে পালান ২০২৪ সালের নভেম্বরে। এখন তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে বিভিন্ন টিভিতে তিনি টকশোতেও অংশ নিচ্ছেন। ৩ নভেম্বর ২০২৪ তাকে তলব করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। তিনি কলকাতা থেকে কীভাবে লন্ডন পালিয়ে গেছেন তাও রহস্যজনক। আমিনুল হক পলাশ লন্ডনে যাওয়ার ক্ষেত্রে এনএসআইয়ের অনুমতি নেননি। তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বা লাল পাসপোর্ট ছিল। কিন্তু ভিসা কিংবা লন্ডন যাওয়ার সরকারি অনুমতিপত্র (জিও) ছিল না। এগুলো ছাড়াই তিনি লন্ডনে পালান। কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে কাজ করার কারণে তিনি ভারত থেকে তার কাছে থাকা বেআইনি সবুজ পাসপোর্টে ব্রিটিশ ভিসা পেতে সক্ষম হন। কূটনৈতিক পাসপোর্ট থাকার পরও সবুজ পাসপোর্ট রাখা বেআইনি। এজন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা।
আমিনুল হক পলাশ এনএসআইতে যোগ দেন ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট সহকারী পরিচালক হিসেবে। তিনি কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাই কমিশনে দ্বিতীয় সচিব (কনস্যুলার) হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে। তার বিরুদ্ধেও জুলাই অভ্যুত্থনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শৃঙ্খলা বিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে বলে এনএসআই জানায়। তাকে গত বছরের ৩ নভেম্বর দেশে ফিরে আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেননি। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার ৬০ দিনের অধিক হওয়ায় তাকেও পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে এবং ডিজারশনের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার অফিসে ফাইল পাঠিয়েছে এনএসআই।
ড. ইউনূসকে হয়রানি প্রসঙ্গে তার আইনজীবী
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মামলা দিয়ে যত ধরনের হয়রানি করা যায়, তার কোনোটাই বাদ দেননি শেখ হাসিনা। তাকে আদালত ভবনের লিফট বন্ধ রেখে ৮ তলার উপরেও হেঁটে উঠানো হয়েছে। এমন শাস্তি সম্ভবত আর কেউ পায়নি বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন।
ব্যারিস্টার মামুন বলেন, একের পর এক মামলা করে এবং গোয়েন্দা সংস্থা লাগিয়ে ড. ইউনূসকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসা নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনাকে বিতর্কিত করার নীলনকশা হিসেবে এসব মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
আমার দেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করা, হয়রানি করার ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এনএসআইয়ের তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম জোবায়ের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা পেয়েছিলেন। তিনি আমিনুল হক পলাশকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে পলাতক। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার মামুনের মন্তব্য জানতে চাইলে আমার দেশকে তিনি বলেন, ড. ইউনূস সাহেবের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কোনো ভিত্তি বা আইনগত মেরিট ছিল না। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এসব মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা দিয়ে কীভাবে একজন নোবেল লরিয়েটকে হয়রানি করা হয়েছে, সেটা গোটা বিশ্ববাসী দেখেছে। অনেক দেশ ও খ্যতিমান ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার এসব অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন।
ড. ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার নির্মম শিকার বলে মনে করেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সীমাহীন হয়রানি ও নির্যাতন করেছেন। এটি বিশ্বে বিরল ঘটনা।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার খোকন বলেন, ড. ইউনূসকে হয়রানি করে শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মামলায় ঢাকা কোর্টে অনেক আসামিই যান। কাউকে কোর্টের লোহার খাঁচায় তেমন একটা নেওয়া হয় না। কিন্তু শেখ হাসিনার আদালত ড. ইউনূসকে খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে অপমানের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছিলেন।