
সাবিনা আহমেদ
ট্যাগিং এবং ডানপন্থা:
পারিবারিকভাবে আমি সারা জীবন ডানপন্থী। অনলাইনে লেখালেখি শুরু করি ২০১৩ সালে। তখন হাসিনার আমল, আর সেই আমলে সকল মজলুমের পক্ষে আমি কলম ধরি। বিএনপি, জামায়াত, শিবির, হেফাজত, বিহারী এবং সাধারণ মানুষ, যার উপরেই রাষ্ট্রীয় খড়্গ নেমে এসেছে আমি তার উপরেই লিখেছি। কোনও ভেদাভেদ করিনি। জুলুমের বিরুদ্ধে লিখতেই মূলত আমার অনলাইনে আসা। রাজনৈতিকভাবে আমি ৫ম সংশোধনীর জিয়ার পক্ষে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নই।
আমার জীবনের ফরমেটিভ সময়ের মাত্র ১৬ বছর আমি বাংলাদেশে থেকেছি, তারপর তিন দশকেরও উপর আমি আমেরিকায়, এখানেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া, চাকরি, ঘরসংসার।
আমেরিকায় এসে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটেনের সাথে, কিন্তু স্বাধীনতার পর আমেরিকা আর ব্রিটেনের মধ্যে যেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তা আজও বিদ্যমান। যেই জার্মানিকে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বোমা মেরে তামা তামা বানিয়ে ফেলেছিল তারাই এখন আমেরিকার অন্যতম মিত্র দেশ। দুই দেশের মধ্যে ডিফেন্স প্যাক্ট আয়রন ক্ল্যাড। এসব যুদ্ধের জন্য ব্রিটেন যেমন কোনোদিন আমেরিকার কাছে ক্ষমা চায়নি, আমেরিকাও তেমন জার্মানির কাছে ক্ষমা চায়নি। এদেশে বাংলাদেশিরা পাকিস্তানিদের সাথে বন্ধুত্ব করে, ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়। অতএব, লাইক এ সিভিলাইজড পার্সন, আমিও জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মনের মধ্যে শাহবাগীদের মতন ঘৃণা পোষণ করিনা।
আমি সর্বদা সেন্টার-রাইট, তবে ফার-রাইট নই। আমার প্রথম লেখাটাও হিযাবকে সাপোর্ট করেই লিখেছিলাম। ফেসবুকে অনেকের লেখা পড়তাম। এখানে সেখানে কমেন্ট করতাম। সেই সময় হুট করে ক্যাপ্টেন নিমো একদিন আমাকে জেড ফোর্স নামক অনলাইন জাতীয়তাবাদী গ্রুপে এড করে। তার এক সেকেন্ড আগেও এই গ্রুপ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।
যারা জানেন না, জেড ফোর্স ২০১৩-এর দিকে অনলাইনে বিএনপি অ্যাকটিভিস্টদের সবচেয়ে বড় একটা গ্রুপ ছিলো। আমার জানা অনেক সুদক্ষ অ্যানালিস্ট এই গ্রুপের সদস্য ছিলো —শাফকাত রাব্বি অনিক, রেজ এজেকিয়েল, নায়েল রহমান, দাসত্ব প্রমুখ। এদের সেখানে দেখে আমি গ্রুপে থেকে যাই।
অল্পদিন পর দেখলাম, আমার চিন্তাধারা গ্রুপের এডমিনদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিহারীদের নিয়ে লিখতে বারণ করলে বুঝলাম, এরা সকল মজলুমের পক্ষে নয়; শুধু বিএনপির মজলুমদের। বেগম জিয়াকে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরোধের পর বিএনপির অক্ষমতা উপলব্ধি করে শিবিরের সঙ্গে মিলে রাজপথে থাকার প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু একত্রিত কাজের সুবিধা বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। ট্যাগ খেলাম। জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায় তো দূরের কথা, নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেতা সালাহউদ্দিন কাদেরের প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসির রায়েও এরা চুপ থাকল। বুঝলাম, এদের নৈতিকতা তলানিতে। হাসিনা বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেশের স্তম্ভগুলো ভেঙে ফেলল, কিন্তু এরা উপলব্ধি করল না। জামাতের নেতাদের প্রহসনের বিচারে যে বিচার বিভাগ একেবারে ভেঙ্গে পড়ছে তা এদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরা পড়ল না।
কিন্তু আমি প্রকাশ্যে প্রহসনমূলক বিচারের বিরোধিতা করে লিখলাম। সালাহউদ্দিন কাদেরের ফাঁসির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রায়ের বিপক্ষে লিখলাম। কিন্তু গ্রুপের বাকিরা কোনও মোরাল স্ট্যান্ডিং নিলো না, কেবল ৩-৪ জন ছাড়া। গ্রুপে এ নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলো। আমি সহ এই ৩-৪ জন ট্যাগ খেলাম—জামায়াতি ট্যাগ। আমরা কয়েকজন একসাথে গ্রুপের ভিতর গ্রুপের স্ট্যান্ড এবং ট্যাগিংয়ের প্রচন্ড বিরোধিতা করলাম ।
মোরালি এন্ড এথিক্যালি যেহেতু আমরা দুই ধারার মানুষ, তাই কিছুদিন পরপরই বাগবিতণ্ডা হতো। এর মধ্যে ঠিক করলাম, জেড ফোর্স ছেড়ে দিবো । যে গ্রুপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। যেখানে আমার লেখা-চিন্তায় বাবা-স্বামীকেও হস্তক্ষেপ করতে দিই না; সেখানে এরা তো আমার কাছে মাছির মতো।
এরই মাঝে কোনও একদিন মেজর ডালিম (নকল) ভিন্ন এক কারণে বলল, চলেন আমরা ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রোফাইল কালো করি। এই কালো করার সাথে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির কোনও সম্পর্ক ছিল না। ডালিমসহ আমরা করলাম, কিন্তু ট্যাগ খেলাম শুধু আমি। ডালিমকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন সে সেদিন প্রোফাইল কালো করতে বলেছিল; বিস্তারিত মনে পড়ছে না।
বিরক্তি চরমে পৌঁছাল। গ্রুপ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন ইনবক্সে তিনজন এল: ইমামুল (কম্বল চোরা ), শহিদুল ইসলাম বাবুল (কৃষক দল), আর তীরো আন্দাজ। বলল, প্লিজ এখনই গ্রুপ ছাড়বেন না; আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে।
তারা পরিকল্পনামাফিক আমাকে না জানিয়ে জেড ফোর্স গ্রুপের এডমিন বানালো । তীরো আন্দাজকে জানালাম আমি এডমিনশিপ ছাড়ব, তিনি অনুরোধ করল কিছুদিন থাকার। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওনার অনুরোধ রাখলাম। গ্রুপের বাইরে টেম্পোরারি গ্রুপ খুলে সমমনাদের নিয়ে এল: শহীদুল ইসলাম বাবুল, তীরো আন্দাজ, ইমামুল, কে এম নাজমুল, নাজমুল হাসান, দাসত্ব, রাশেদ খান, ফাতেমা, জুল ভার্ন, ইলোরা, হাফিজুল্লাহ প্রমুখ।
ঠিক হলো একদিন আমরা সবাই মিলে জেডফোর্স গ্রুপে একসাথে উপস্থিত হয়ে আমাদের এই ট্যাগিং এর বিরোধিতা জানিয়ে সবাই একসাথে গ্রুপ ত্যাগ করব। পরিকল্পনা মাফিক সেদিন প্রোটেস্ট করে প্রথম পোস্টটি সম্ভবত জুল ভার্ন ভাই দেন। এরপর শুরু হয় ক্যাওস। এই ক্যাওটিক পরিস্থিতিতে আমার ইনবক্সে আমার সাথে থাকে শহিদুল ইসলাম বাবুল, আর ইমামুল। গ্রুপের মধ্যে সবাই তখন খুব উত্তেজিত হয়ে মোমেন্ট করছে। আমার ক্যাওস সহ্য না হলে তীর আন্দাজ ভাই বললেন আমাকে বললেন আপনি ঘুমাতে যান, বাকিটা আমরা দেখব। ততক্ষণ আগের এডমিনদের গ্রুপে রাখা হলেও তাদের এডমিনশিপ কেড়ে নেয়া হয়; আর কে এম নাজমুল এর নাজমুল হাসানকে এডমিন প্যানেলে ঢোকানো হয়। আমি ফেসবুক বন্ধ করে ঘুমাতে চলে যাই। ডিসিশন নেই সকালে উঠে আমি গ্রুপ ত্যাগ করব। কিন্তু সকালে দেখি, পুরাতন এডমিনদের সবাইকে গ্রুপ থেকেই বের করে দেওয়া হয়েছে। সাথে আরও অনেককে গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
কথা ছিল জেডফোর্স গ্রুপ থেকে আমরা বের হয়ে যাব, কিন্তু বের করে দেয়া হলো নিমো-ওসমান-কামরুল-ইয়াসিন-ধ্রুব মহাকালদের। অল্প কয়েকদিন পর দাসত্ব আমাদের জানিয়ে গ্রুপ ইনেকটিভ করে দেয়। দুজন এডমিনের হাতে পুরাতন জেড ফোর্স কিন্তু এখনও আছে।
৫ অগাস্টের পর ভেবেছিলাম, গ্রুপটাকে আমি নিমোর হাতে ফিরিয়ে দেব। কিন্তু আলোচনা সাপেক্ষে তা করা হয়নি। কারণ, তারা এখনও ট্যাগিং কালচার থেকে বেরোয়নি। বরং আগের চাইতে বাড়িয়েছে।
গ্রুপ যে কিছু ভালো কাজ করেনি তা নয়, আমিও তাদের সেসব কাজের সাথে থেকেছি- জিয়ার উপর বই বের করা, ৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের খবরের আর্কাইভিং করা সব কিছুতে আমি ইনভলভড ছিলাম। জেডফোর্সের পেইজটাকে নিজের ডলার দিয়ে বুস্ট করে করে অনেক জনপ্রিয় করে তুলেছিলাম। গ্রুপ থেকে বের হওয়ার পর তাবিথ আউয়ালের প্রথম মেয়োরিয়াল ইলেকশনের পেইজের মূল দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। আর অল্প কয়দিনে পেইজটাকে ভাইরাল বানিয়ে দিয়েছিলাম। মিসেস আব্বাসকে বলে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনে মির্জা আব্বাসের পেইজটা কেএম নাজমুলদের পাইয়ে দিয়েছিলাম। বিএনপির তৃণমূলের মজলুমদের একে তাঁকে টাকা ডোনেট করেছি। আসল কাজ যা করেছি সব বিএনপির জন্য করেছি, কোনদিন জামায়াতের জন্য কোন কাজ করিনি। কিন্তু সেই আমাকেই বারংবার জামাতি ট্যাগিং এর শিকার হতে হয়েছে।
যে ট্যাগিং কালচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেনজিরা হাসিনাকে দেশছাড়া করেছে, ডাকসু-জাকসুতে শিবিরের ঐক্য প্যানেলকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে—সেই কালচারের বিরুদ্ধে ১২ বছর আগে আমরা প্রবল আপত্তি উঠিয়েছিলাম। ডানপন্থীদের টুটি চেপে ধরার প্রয়াসে রাজাকার-জামায়াতি ট্যাগ করার যে অপকৌশল কিছু মানুষ ব্যবহার করে তাতে দিন শেষে বিএনপিরই ক্ষতি হয়েছে। এই ডানপন্থী খুব কাজের মানুষগুলোর সাথে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
১২ বছর পর জেড ফোর্স বিলুপ্তির আসল কারণ জানালাম কেন? যে ভুল প্রাক্তন এডমিনরা করেছে, সেই ভুল বিএনপির সমসাময়িক অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা করছে। মতের বাইরে গেলে জামায়াতি ট্যাগ দিচ্ছে। ডানপন্থীদের সাথে কাউকে দেখলেই তাঁকে জামাতি বলা হচ্ছে। ১২ বছর আগে গ্রুপ ভেঙ্গে বের হয়ে গিয়েছিলাম আমর অনেকেই। দুইদিন আগে বিএএফ ছেড়ে বের হলো রাহাত শান্তনু আর শাফায়েত আহমেদ। এভাবেই বিএনপির ইন্টারনাল গ্রুপ থেকে ভালো ভালো অ্যাকটিভিস্টরা বের হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে বিএনপি একদিন মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
লেখক: পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ