
গত ১০ দিন যাবৎ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছেন ইউনুছ মিয়া। নরসিংদী সদরের বাসিন্দা তিনি। বয়স ৬৯ বছর। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে শুরুতে স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ভর্তি হন ১২ই সেপ্টেম্বর। বর্তমানে হাসপাতালটির ৪০২ ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ৫ নম্বর শয্যায় জ্বর নিয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি। একই ওয়ার্ডে আরেক ডেঙ্গু রোগী কবির হোসেন ২৬ নম্বর শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ১০২ ডিগ্রির উপরে জ্বর ওঠে। পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার মোড় এলাকায় তার বাসা। তিনি জানান, রাতে মশারি টানানোর অভ্যাস নেই তার পরিবারের। তার সন্দেহ মশা হয়তো এই সুযোগে কোনো একসময়ে তাকে কামড় দিয়েছে। মেডিসিন ওয়ার্ডের ৬০১-এর বারান্দার মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৭ বছর বয়সী আরেক ডেঙ্গু রোগী হৃদয়। এসেছেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ব্যাংক কলোনি থেকে। ওয়ার্ডের মূল সিটে তার ঠাঁই হয়নি। তাই তিনি ফ্লোরে থেকে সেবা নিচ্ছেন বলে জানান তার স্বজনরা।
গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তাদের মতো আরও অনেক ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন। হাসপাতালের চতুর্থতলায় তাদের জন্য ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ড ছাড়াও মেডিসিন ওয়ার্ডের সামনে সিঁড়ির গোড়ায় ডেঙ্গু রোগীদের কোনো রকম ঠাঁই হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর কারণে প্রতিদিনই চাপ বাড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। মেডিসিন ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক জানান, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী আসছে তাদের ওয়ার্ডে। রোগীর চাপ থাকায় মূল সিটে জায়গায় না হওয়ায় রোগীদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
চলতি বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ২৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯৩ জন রোগী। হাসপাতালটিতে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪১ জন মারা গেছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন এক হাজার ৪৮৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৬৫ রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময় মারা গেছেন একজন। এ বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৯ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ১১ হাজার ৬৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। রাজধানীর উত্তর সিটিতে ডেঙ্গু রোগী ৪ হাজার ৪৬ জন, দক্ষিণে ৫ হাজার ৯৮৭ জন, চট্টগ্রামে ৬ হাজার ১২ জন, ঢাকার অন্যান্য জেলায় ৫ হাজার ৬৩৬ জন, খুলনা বিভাগে ২ হাজার ২৩ জন, ময়মনসিংহে ৭৬৫ জন, রাজশাহীতে ২ হাজার ৬৯২ জন, রংপুর বিভাগে ২৭২ জন এবং সিলেটে ১১৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এবার।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রায়ই স্থানীয় হাসপাতাল থেকে শহরের বড় হাসপাতালগুলোতে রেফার করা হয়। তিনি বলেন, এই রোগীরা যখন এসে পৌঁছান, তাদের অবস্থা প্রায়ই সংকটাপন্ন থাকে। অনেকেই রাজধানীর বাইরে আক্রান্ত হলেও ঢাকার হাসপাতালে এসে মারা যান। শহরে মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার এটি একটি কারণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা শুরুর আগে সময়ক্ষেপণ একটি বড় সমস্যা। অনেক জেলা থেকে ঢাকায় আসতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে, এরপর হাসপাতালে ভর্তির জন্য আরও কিছু সময় চলে যায়। কোনো রোগী যদি আগে থেকেই শকে থেকে থাকলে চিকিৎসায় বিলম্বে প্রাণঘাতী হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. আহসান। তিনি বলেন, কেবল গুরুতর অবস্থার রোগীদের ঢাকায় স্থানান্তর করা উচিত। অনেক সময় রোগীর অবস্থা ততটা গুরুতর না হলেও, ভয়ে দ্রুত রেফার করে দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, শকে থাকা রোগীদের স্থিতিশীল অবস্থায় আনার পরই কেবল স্থানান্তর করা উচিত।
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ড চালুর নির্দেশ: ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সব সরকারি হাসপাতালে বিশেষ ওয়ার্ড ও নির্দিষ্ট চিকিৎসক টিম গঠনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মঙ্গলবার জারি করা এক জরুরি প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানের স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতালগুলোতে আলাদা ওয়ার্ড ও চিকিৎসক দল গঠন করা আবশ্যক। এনএস-১ টেস্ট, পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, মেডিসিন, শিশু চিকিৎসকসহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করতে হবে। সেই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা শুধুমাত্র ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। সন্দেহভাজন রোগীদেরও বহির্বিভাগে নির্দিষ্ট কক্ষে পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতাল এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধনের জন্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাকে চিঠি দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি শনিবার সকাল ১০টায় হাসপাতাল পরিচালক ও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে সমন্বয় সভা আয়োজনের কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উদ্যোগ রোগী সেবাকে আরও সংগঠিত করবে এবং চিকিৎসার মান উন্নত করবে। একইসঙ্গে ডেঙ্গুজনিত জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।
সহায়ক হবে।