Image description

রাজধানী ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল। এর পরই আসে গুলশান ও তেজগাঁওয়ের নাম। গুলশান একদিকে যেমন ব্যবসায়িক কেন্দ্র, তেমনি এখানে বাস করে দেশের ধনীদের বড় অংশ। সম্প্রতি এ বাণিজ্যিক ও অভিজাত এলাকাগুলো তুলনামূলক বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হিসাবে গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুলাই) ঢাকায় সংঘটিত ‘দাঙ্গা’র ঘটনাগুলোর প্রায় তিন-চতুর্থাংশই হয়েছে মতিঝিল, গুলশান ও তেজগাঁও বিভাগে। অপরাধ হিসেবে ‘মব সহিংসতা’কে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল ব্যাংক পাড়া নামেও পরিচিত। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্যিক এলাকায় বিভিন্ন সময় দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। এমনকি মতিঝিল থানার ভেতরে প্রবেশ করেও মবের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৯ জুলাই ৩০ থেকে ৩৫ জনের মব মতিঝিলের একটি বাণিজ্যিক ভবন দখলের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে মবকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে তাদের বেশ কয়েকজন দলবদ্ধভাবে থানায় হামলার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।

মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে অধিকাংশই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নানা সময়ে দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্মসূচি পালন করে থাকেন। উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনা সমাধান করা হয়।’

শুধু মতিঝিলেই নয়, গুলশানেও গত ছয় মাসে কয়েকটি মবের ঘটনা ঘটছে। ৫ মার্চ গুলশান-২ নম্বরে ৮১ নম্বর সড়কের একটি বাসা ঘেরাও করে মব তৈরি হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ওই বাসার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক শাকিল আহমেদ। তিনি বাসাটিতে ২০০-৩০০ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে—এমন গুজব ছড়িয়ে সেখানে বেআইনিভাবে তল্লাশি চালাতে জনতাকে উসকানি দেন। বাসাটি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর। তানভীর সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচটি ইমামের ছেলে এ তানভীর। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। সে সময় ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে যে শাকিল আহমেদ একসময় ওই বাসায় কেয়ারটেকারের (তত্ত্বাবধায়ক) কাজ করতেন। তিনিই মূলত জনতাকে ২০০-৩০০ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে, এমন তথ্য দিয়ে বাসায় তল্লাশি চালাতে উসকানি দেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর বাণিজ্যিক ও অভিজাত আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন সময় মবের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মতিঝিল, গুলশান ও তেজগাঁওসহ বাণিজ্যিক এলাকায় মবের ঘটনা ব্যবসায়িক আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি ভোক্তারাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত করছে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঢাকা চেম্বার মনে করে আইন-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখা ও সঠিক সময়ে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে এ ধরনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’

গত ২৭ জুন রাতে ঢাকার আরেক অভিজাত এলাকা বারিধারা কূটনৈতিক জোনের ২ নম্বর ইউএন রোডের ছয়তলা একটি বাড়ির দুটি ফ্ল্যাটে পরিকল্পিত হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। ওই ভবনের ২০১ নম্বর ফ্ল্যাটে বাস করেন ক্যাপিটাল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাররম হোসেইন খান। এছাড়া ৪০১ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন মোকাররম হোসেইনের মেয়ে ক্যাপিটাল্যান্ডের নির্বাহী পরিচালক মাহিরা হোসেইন খান। এ ঘটনায় মব সৃষ্টি করে ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ ওঠে মবকারীদের বিরুদ্ধে। জানা যায়, মতিঝিল ও গুলশানের পাশাপাশি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায়ও বেশ কয়েকটি মবের ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক মাসে। এ এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এসব মবে আক্রান্ত হয়েছে।

পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাঙ্গা বলতে পাঁচজনের অধিক মানুষ একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জানমালের ক্ষতি করাকে বোঝানো হয়। আর মব শব্দটির ব্যবহার একেবারেই সাম্প্রতিক। এর মাধ্যমে বেআইনিভাবে সংঘবদ্ধ জনতার আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াকে বোঝানো হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে পেনাল কোডে বেআইনিভাবে দলবদ্ধ হয়ে পাঁচজনের অধিক মানুষ কোনো অপরাধ সংঘটিত করলে সেটাকে দাঙ্গা বলা হতো। সাদৃশ্য থাকায় মবের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ ‘দাঙ্গা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে রাজধানীতে ৩৮টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩টি ঘটেছে মতিঝিল এলাকায়। এরপর সর্বোচ্চ গুলশানে আটটি এবং তেজগাঁও এলাকায় সাতটি। এছাড়া এ সময় রাজধানীতে ২৩১টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তেজগাঁওয়ে ৫০টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মতিঝিলে ৪৬টি এবং গুলশানে ১৫টি দস্যুতার ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত হয়েছে। জখমের ঘটনাও এসব অভিজাত ও বাণিজ্যিক এলাকায় বেশি ঘটেছে। গত ছয় মাসে রাজধানীতে ৫০৩টি জখমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২৯টি জখমের ঘটনা মতিঝিলে। এছাড়া গুলশানে ৭২টি এবং তেজগাঁওয়ে ৬০টি জখমের ঘটনা ঘটেছে।

মব অপরাধ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মবের মতো ঘটনা প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হয়েছে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা বরদাশত করা হবে না। নিয়মিত টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়মিত চেকপোস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।’

দাঙ্গা আর মবকে সমধর্মী অপরাধ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একাডেমিক্যালি কখনো কখনো দাঙ্গা আর মব সদৃশ অপরাধ। আবার সূক্ষ্ম পার্থক্যও রয়েছে। তবে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে দেখলে এটা দাঙ্গার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কারণ দুই ধরনের অপরাধেরই প্রভাব এক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরাসরি মব রিলেটেড কোনো আইন আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় নেই। সব পেনাল কোড তৈরি হয়েছে ১৮৯৮ সালে। তখন সংঘটিত দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য পেনাল কোডে দাঙ্গার ধারাটি যুক্ত করা হয়। এখন মবকেও অপরাধ হিসেবে পেনাল কোডে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সময়ের পরিবর্তনে অপরাধের যে বিবর্তন ঘটেছে সেখানে এটা খুবই প্রয়োজন।’

বাণিজ্যিক এলাকায় মবের কারণে অর্থনীতিতে আস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ড. তৌহিদুল হক। তার মতে, বাণিজ্যিক এলাকা বা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মবকারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘটনা ঘটতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্যোগ সংকুচিত হয়ে আসবে। নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করা নিরাপদ মনে করবে না। দ্বিতীয়ত, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তারাও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বোধ করবেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এগুলো যদি একটা সমাজের মধ্যে চলতে থাকে তাহলে আমাদের দেশের কর্মসংস্থান কমে আসবে। দেশীয় অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়বে। এটা সামগ্রিকভাবে সবার জন্য ক্ষতিকর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্ত হাতে এ ধরনের অপরাধ দমন করতে হবে।

দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অর্থনীতির অনুকূলে নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কর্মসংস্থান হচ্ছে না বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায়। বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা। পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না বলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না, ভয় পাচ্ছেন। তারা একটি নির্বাচিত স্থিতিশীল সরকার চান।’

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর যেমন মব তৈরির একটা পরিস্থিতি ছিল, সে তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। তবে দু-একটা ঘটনা যে ঘটছে না তা বলব না। মতিঝিল ও গুলশানের মতো এলাকায় মানুষ টাকার জন্য মব তৈরি করছে। আমরা পুলিশকে মব নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তবে শুধু পুলিশ চাইলেই হবে না, এখানে সকল স্তরের মানুষের সহযোগিতা লাগবে। আমরা বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে আলাপ করছি। তাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা পুলিশের পেট্রোল গাড়িগুলোয় ট্র্যাকিং সিস্টেম স্থাপন করেছি। কোথাও মব হলে সেখানকার পরিস্থিতি মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করছি।’