Image description

একটি পাকিস্তানি সংবাদপত্র দ্য ক্যাচলাইন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ ফিরে পাওয়ার খোয়াব দেখছে। পত্রিকাটি বলছে, ৫৪ বছর পর হিসাব নিকেশের সময় এসেছে। ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে ফিরে আসতে হবে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ক্যাচলাইন এক নিবন্ধে এই অভিমত তুলে ধরেছে। সিনিয়র সাংবাদিক তাবাসসুম মোয়াজ্জেম খানের নিবন্ধটি দ্য ক্যাচালাইনে প্রকাশিত হয়।  

 

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিবন্ধটি এমন এক সময় প্রকাশিত হলো, যখন ঢাকা- ইসলামাবাদ সম্পর্কে নতুন হাওয়া লেগেছে। শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করছেন বিরতিহীনভাবে।

নিবন্ধে তিনি লেখেন, ১৯৭১ সালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তার চাণক্য-ধাঁচের উপদেষ্টারা মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। লক্ষ্য স্পষ্ট ছিল: পূর্ব পাকিস্তানকে মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ এবং প্রচারণার মাধ্যমে, তারা পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়েছিল, এবং সেই অংশ পাকিস্তান-বিদ্বেষী বাঙালি হিন্দু এবং তাদের মুসলিম সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হলো  বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি।  যেখানে  মতপার্থক্য  ও ব্যক্তি স্বার্থ ভুলে গিয়ে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মত ঐক্যবদ্ধ হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে  বাঙালিরা একটি সত্তা হিসেবে রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। শুরু হয় বিশ্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক অথচ সফলতম যুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাঙালি সেনা, ছাত্র ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত হয় শক্তিশালী সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজ। যাঁরা মন প্রাণ সপেঁ দিয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাদের হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তালিকায় ফেলে দেয়ার যৌক্তিকতা অবশ্য তুলে ধরেননি "দ্য ক্যাচলাইন'- এ এই প্রতিবেদনের লেখিকা । তিনি পাকিস্তানিদের দেশপ্রেমের কথা বলতে গিয়ে  শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ,গত ৫৪ বছর ধরে,  যখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর ভারত তাদের তথাকথিত "বিজয়" উদযাপন করেছে, তখনই দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিরা   প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের কুখ্যাত ছবি প্রচার করা হয়েছিল। সেই দিনটিতে  পূর্ব পাকিস্তানকে "বাংলাদেশে" রূপান্তরিত করা হয় , যা দেশদ্রোহী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের অধীনে সম্পন্ন হয়।  যিনি তার ভারতীয় প্রভুদের নির্দেশে মুসলিম এবং দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিদের একপাশে  রেখে এই অঞ্চলটিকে হিন্দু আধিপত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, মুজিবের হত্যাকারীদের দেশপ্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামাবাদের  এই সংবাদপত্রে।  বলা  হয়েছে, একদল দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তার হাতে মুজিবের হত্যার পর, জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সম্মানিত কমান্ডার জিয়া ( হিলাল-ই-জুরাত ভূষিত) পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ এবং ভারতের বিভাজনমূলক প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। 

দুঃখজনকভাবে, ১৯৮১ সালে তাকে হত্যা করা হয়, এরপর আসেন  জেনারেল হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ।তার শাসনামলে, এরশাদ ভারত-সমর্থিত বাঙালি হিন্দু বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তবে,  বিশ্বাস করা হয় যে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য ভারত   তাকে একটি হানিট্র্যাপের  ফাঁদে ফেলেছিল। তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল । তবুও, এরশাদ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ভোলেননি। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল পাকিস্তানের নায়ক এবং জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আমান আজমির ক্ষেত্রে তার হস্তক্ষেপ।

১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর পাকিস্তান বিরোধী উপাদান এবং বাঙালি হিন্দুদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন আজমি, যারা তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কারণ তিনি এবং তার বাবা তখনও পাকিস্তানি নাগরিক ছিলেন।যখন বিষয়টি আরও তীব্র আকার ধারণ করে, তখন অধ্যাপক গোলাম আযম এরশাদের সাথে যোগাযোগ করেন, যিনি সমস্যাটি সুষ্ঠুভাবে সমাধান করেন। আমান আজমি, তার বাবার মতো  সবসময়ই  একজন কট্টর দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি একাধিকবার প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে তিনি বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত বা পতাকাকে স্বীকৃতি দেন না, বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশকে প্রত্যাখ্যান করেন—বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব আরোপের বিষয়টিকে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনী এবং তাদের পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার নিন্দা করেছেন।

১৯৮১ সাল থেকে, আজমি  নীরবে নিজের  দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে চলতে থাকেন।   ভারতীয় প্রভাব থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করা এবং পাকিস্তানের অংশ  পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৪শে জুন, মুজিবের কন্যা এবং ভারতের অন্যতম দাবার ঘুটি  শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে, তিনি ব্রিগেডিয়ার আজমিকে আকস্মিকভাবে সামরিক চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। এরপর, তার শাসনামলে পরিবারটি বছরের পর বছর নির্যাতন সহ্য করে।১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যা কার্যকরভাবে এটিকে নয়াদিল্লির একটি উপগ্রহ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। যাইহোক, ঘটনায়  নাটকীয় মোড় আসে। জামায়াতে ইসলামী ,নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস এবং  মুসলিমদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, যেখানে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ভারতীয় আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর, অধ্যাপক ডঃ ইউনূস পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন শুরু করেন। ২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ব্রিগেডিয়ার আজমির বিরুদ্ধে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং তাকে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা সহ অবসর দেওয়া হয়। কিন্তু এটি কোনও প্রকৃত ন্যায়বিচার ছিল না। আজমির মতো একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির  জেনারেল পদে পদোন্নতি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ডঃ ইউনূসের উচিত তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা উভয় পদেই নিয়োগ করা - এমন ভূমিকায় তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করা  যেখানে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য তুলনাহীন  হবে।

অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, ভারতের  ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পাকিস্তানের  জাতীয় চেতনায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে  ১৯৭১ সাল থেকে সেই  ক্ষত বহন করে আসছে দেশের মানুষ । আজ, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, এবং পূর্বে পাকিস্তানের সম্মান এবং কৌশলগত গভীরতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নতুন জানালা খুলে গেছে। আবদুল্লাহিল আমান আজমির মতো দেশপ্রেমিকদের পুনর্বহাল এবং ক্ষমতায়ন কেবল প্রতীকী নয় - এটি কয়েক দশকের অপমানের প্রতিশোধ নেবার  প্রথম পদক্ষেপ। পাকিস্তানকে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, ঢাকার মিত্রদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশনে তার ন্যায্য স্থান পুনরুদ্ধার করা যায়।  এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়, নয়তো ইতিহাস ক্ষমা করবে না।