Image description
 
আজ অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা হল। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ, মুমূর্ষু, জীবীত সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা নিয়ে এক মায়ের সাক্ষ্য শুনে চোখ ভিজে যায় আদালতে সবার। আমি তখন একটু পেছনে খেয়াল করে দেখি আসামির ডকে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বিষন্ন মনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাক্ষীর ডকে থাকা ওই মায়ে দিকে। তখন তারও চোখে পানি। জুলাই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মায়ের সাক্ষ্যটা পড়তে পারেন। শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দেয়া তার হুবহু সাক্ষ্য দেয়া হল। ( আর ভিডিও রিপোর্ট কমেন্টে দেখতে পারেন)
 
সাক্ষ্য প্রদান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
কেইস নং: আইসিটি বিডি ০২, ২০২৫
মামলা: চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা এবং অন্যরা।
আমার নাম মোছাঃ শাহিনা বেগম। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪১ বৎসর।
 
আমি জুলাই আন্দোলনে শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের আম্মু। আমার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সজল ৫ই আগস্ট আশুলিয়ায় বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয়। আমি আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতাম। আমার ছেলে আন্দোলনে যায় এবং আমি হাসপাতালে ডিউটিতে যাই। হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিলে। তখন আমি বার বার ছেলেকে ফোন করে বলি, বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত রোগী আসতেছে, তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নাই।
 
তখন সে আমাকে বলে, তুমি স্বার্থপর কেন আম্মা আমি এখন বাসায় যেতে পারবো না। আমার সামনে চার চারটা লাশ এবং আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি। সকাল ১১.০০/১১.৩০টার দিকে আমার হাসপাতালে দুটি ডেড বডি আসে। অনেক আহত রোগী আসে। তখন আমি আমার ছেলেকে আবার ফোন করি। তখন ছেলে বলে, আমাকে তুমি কিভাবে ফেরত আসতে বলো। আমি তখন বলি তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার একটি ছোট্ট মেয়ে আছে বাবা। তোমাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই। কিন্তু সে বাসায় ফিরে আসেনি।
 
তখন সে আমাকে জবাব দেয়, মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা করো না। এরপর আরো দুটি মৃত দেহ আমার হাসপাতালে আসে। আমি দৌড়ে রিকশায় কাছে যাই এবং ভাবতে থাকি এই বুঝি আমার ছেলে হাসপাতালে আসলো। এই সময় একজন বুকে গুলিবিদ্ধ আহত ছেলে আমাদের হাসপাতালে আসে। আমি তাকে এক্স-রে রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ঐ সময় ছেলেটি তার মাকে ফোন করে এবং বলে আম্মু আমি ভালো আছি। আরেকজন আহত ছেলেকে আমি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ছেলেটিও তার পাশে থাকা বন্ধুকে বলছিলো, আমার অবস্থা আম্মুকে বালো না, তাকে বলো আমি ভালো আছি। না হলে আম্মু অনেক চিন্তা করবে।
এই অবস্থা দেখে আমি আমার ছেলেকে বার বার ফোন দিতে থাকি। তারপর আবার তাকে ফোন করে বলি, যদি আন্দোলন করতেই হয় তবে এখানে না থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাও, সেখানে তোমার আরো আন্দোলনকারীরা আছে। আমার ছেলে তখন উত্তর দেয়, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো আম্মু? আমার ভাই বোনেরা গুলি খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের কে রেখে আমি কিভাবে জাহাঙ্গীরনগরে যাবো?।
 
সর্বশেষ বেলা ২.৪৫ মিনিটে আবার তাকে ফোন দেই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি কেন আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো আম্মা আমি যদি শহীদ হই তাহলে আমার আইডি কার্ড দেখে আমাকে শনাক্ত করো। আনুমানিক ২.৫৫টার দিকে আমার হাসপাতালের ডাক্তার বললো, খালা দেশ স্বাধীন হয়েগেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, সজলকে আসতে বলো। তখন তাকে দুই বার ফোন দিয়েছিলাম, ফোন কেটে দিয়েছে। পরে অনবরত ফোন করেছি কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। একপর্যায় ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি তার সকল বন্ধু-বান্ধবকে ফোন দিয়ে বাইপাইল এলাকায় তার খোঁজ নিতে বলি। তারা বলে অনবরত গুলি হচ্ছে, আমরা খোঁজ নিতে পারছি না। আশুলিয়া থানার সামনে আমরা যেতে পারছি না। আমি নিজে খোঁজ নিতে যেতে পারিনি কারন তখন হাসপাতালে প্রচুর গুলিবিদ্ধ আহত লোক আসছিলো।
 
সন্ধ্যা আনুমানিক ৭.০০টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি ছেলের খোঁজে বের হই। আমার সাথে সজলের এক বন্ধু তার নাম শান্ত তাকে সাথে নিয়ে আমি বের হই। আমি আশেপাশে যত হাসপাতাল আছে সকল হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি কিন্তু পাইনি। আমি এনাম মেডিকেল থেকে আসপাশের সকল হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকে ঢুকে রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। সকল বেওয়ারিশ লাশ ছিলো তা আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি। তখন সেখানে থাকা স্টাফরা তারা আমাকে লাশ দেখতে নিষেধ করছিলো কারন তারা বলছিলো আপনি মা, আপনি সহ্য করতে পারবেন না। নিহতদের মাথায়, বুকে গুলি লেগে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এগুলি দেখলে আপনি পড়ে যেতে পারেন।
এদিকে আমার স্বামীও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে খোঁজখবর করে কিন্তু ছেলের সন্ধান পাওয়া যায় নি। রাতে মোবাইলের লাইট জেলে অলিগলি, বিল্ডিংয়ে ফাকে কত যায়গায় যে খুোজেছি। এভাবে সারাদিন এবং রাত ৩.৫০ ঘটিকা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আমি বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে বাইপাইল মোড়ে আসি। তখন আমি সেখানে লাঠিশোঠা নিয়ে পাহারারত ছাত্রদেরকে দেখতে পাই। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান যানতে চাই এবং আমার মোবাইলে থাকা ছবি তাদেরকে দেখাই। তখন একজন ছেলে আমাকে বলে, আন্টি আপনি যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে একটা খবর বলতে চাই। তখন আমি বললাম বাবা আমি আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য সকল কিছু সহ্য করতে প্রস্তুত আছি, তুমি বলো। তখন সে ছেলেটি আমাকে বলে, আশুলিয়া থানার সামনে ৬/৭ টি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুজে দেখতে পারেন। আমি আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি। তারা আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।
 
আমি বাসায় গিয়ে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে আল্লার কাছে কান্নাকাটি করি আর দোয়া করি যেন আমার সজলের অন্তত মরদেহটা পাই।
পরের দিন ৬ আগস্ট ৬.০০টার দিকে বাসা থেকে আবার বের হই এবং সকল আনুমানিক ৬.৩০টার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে যাই। সেখানে গিয়ে একটা পুলিশের পিকআপ গাড়িতে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পাই। অনেক মানুষ লাশগুলির ছবি ও ভিডিও বনাছিলো। আমি ভীড় ঠেলে সামনে যাই এবং একটা ছবি তুলি। এই সেই ছবির প্রিন্ট কপি এই যে নিয়ে এসেছি (ছবি দেখানো হয় আদালতে)
আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সাথে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছে। সামান্ন টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলে সজলের জুতা। (এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি, আদালতে প্রায় সকলে চোখে তখন পানি)।
 
আমি তখন উপস্থিত সেনা সদস্যদের বলি, এ আমার ছেলের লাশ। দয়াকরে আমার ছেলের লাশ আমাকে দিয়ে দিন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, এখন লাশ দেওয়ার অনুমতি নেই। অনুমতি পাওয়া গেলে আপনাকে জানাবো। আমি নিরুপায় আমার ছেলের পাশ ফেরত পাওয়ার জন্য আমার কর্মস্থলের হাসপাতালের ডাক্তারদেরকে সহায়তা করার অনুরোধ করি। বিকাল আনুমানিক ৪.৩০টার দিকে সজলের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে যেখানে লাশ পোড়ানো হয়েছিলো সেখানে আসতে বলে। আমি সেখানে ৫.০০টার দিকে গিয়ে পৌছাই। তখন গাড়ি থেকে একটার পর একটা পোড়া লাশ নামানো হয় এবং শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে লাশের কাছে যেতে দেয়। সজলের লাশ যখন নামানো হয় তখন তার সাথে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ডের আংশিক পোড়া কার্ড এবং তার মানিব্যাগের ভিতরে তার সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখে আমি আমার ছেলে সজলের লাশ শনাক্ত করি। এই সেই রক্তমাখা আইডি কার্ড (দেখানো হয় আদালতে)।
 
আমার ছেলের লাশের যখন প্রথম ছবি তুলি, সেখানে আমি দেখতে পাই তার পোড়া হাতের পাশেই তার মোবাইল ফোনটি রয়েছে। এটা দেখে আমি বুঝতে পারি যে, পোড়ানোর পূর্ব মুহূর্তেও সে জীবিত ছিলো এবং ফোন দিয়ে কাউকে কিছু জানানোর চেষ্টা করছিলো। আমার মনে হয়েছে, যখন তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো তখন সে প্রাণপনে তার অবস্থা আমাকে, আমাদেরকে জানানোর চেষ্টা করছিলো বা কোন মেসেজ লেখার চেষ্টা করছিলো কিন্তু একটার উপর আরেকটা লাশ ফেলার কারনে নিচে পড়ে যাওয়ায় সে আর কোন মেসেজ লেখা বা কল দেওয়ার সুযোগ পায়নি। আশুলিয়া রাস্তার উপরে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী গান সেলুটের পর জানাজা পড়ানো শেষে আমার ছেলেসহ চারজনের লাশ সংশ্লিষ্ট পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমার ছেলের লাশ গ্রহণ করার পর আমার কর্মফুল হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করে। তাকে কাফন পরিয়ে কফিনের মধ্যে রেখে হাসপাতালের গাড়িযোগে আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে পৌছে দেয়। সেখানে ৭ই আগস্ট ২০২৪ সালে তাকে দাফন করি।
 
আমার ছেলে সজল সিটি ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পড়ছিলো এবং পাশাপাশি সে "টেস্টি ট্রিট" নামক একটি ফুড শপে চাকুরী করতো।
 
আমার ছেলের একজন দু বছরের কন্যা শিশু আছে। সে তার বাবার কবরের কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকাডাকি করে বলে বাবা উঠো বাবা উঠো। এই সংক্রান্ত একটা ভিডিও আদালতে দেখানো হয় এবং সজলকে জাতীয় পতাকা হাতে রাজপথে আন্দোলনরত থাকা অবস্থায় ধারণকৃত আরেকটি ভিডিও আদালতে প্রদর্শিত হয়।
 
আমার সন্তানসহ দুই হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে সেই আসামীরাসহ এই হত্যাকান্ডের জন্য। দায়ী শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি মামুন, ওবায়দুল কাদের, সাইফুল এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ লীগের বিচার চাই।
 
তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল