
বাংলাদেশ ব্যাংক আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আনুষ্ঠানিকভাবে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। একইসঙ্গে তিনি বিগত ছয় মাসের মুদ্রানীতির কার্যকারিতা এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়েও বক্তব্য দেবেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানসহ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন।
মূল্যস্ফীতি কমেছে, ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে
গত এক বছরে ধারাবাহিকভাবে কঠোর, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করায় দেশে মূল্যস্ফীতির হার কমে জুনে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮ শতাংশে—যা গত ৩৫ মাসে সর্বনিম্ন। অপরদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশে— যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে রেকর্ড সর্বনিম্ন। গত জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৭.১৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৬.৮২ শতাংশ, মার্চে ৭.৫৭ শতাংশ এবং এপ্রিলে ৭.৫০ শতাংশ। মে মাসে তা কিছুটা বেড়ে ৭.১৭ শতাংশে উঠলেও জুনে ফের নেমে যায় ৬.৪০ শতাংশে।
এ প্রবণতা অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কিত করছে। তারা বলছেন, ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাসের অর্থ হলো বিনিয়োগ কমছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে ও উৎপাদনে।
কোন পথে যাবে নতুন মুদ্রানীতি?
বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান নীতি সুদহার বা রেপো রেট ১০ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখবে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ৯ শতাংশ—যা আগের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার (৯.৮ শতাংশ) চেয়ে কম হলেও গত ছয় মাসের প্রকৃত অর্জনের চেয়ে বেশি। সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হতে পারে ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আমরা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছুটা সংকোচনমুখী নীতি অবলম্বন করতে চাই, যাতে মূল্যস্ফীতিকে আরও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়নের লক্ষ্য থাকবে।”
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ ও শঙ্কা
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, নীতি সুদহার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে, এমন নয়। তবে কমালে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই রেপো রেট স্থিতিশীল রাখাই যুক্তিসঙ্গত। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দর কমানো ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় মুদ্রানীতিতে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।”
অপরদিকে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির মনে করেন, উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ঋণের সুদহার কমাতে হবে। আর সেটি করতে হলে স্ট্যান্ডার্ড লেন্ডিং রেট এখনকার ১১.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০.৫ শতাংশে নামাতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরির মতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ এবং ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে।
ব্যবসায়ীদের চাপ: সুদ কমান, বিনিয়োগ বাড়ান
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, “সুদহার ১৫ শতাংশে উঠিয়ে দেওয়ায় অনেক ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। পুরনো ঋণের কিস্তিও সময়মতো পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।”
মুদ্রা সরবরাহ, রিজার্ভ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জুন মাসের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.৭২ বিলিয়ন ডলারে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানি ও রেমিট্যান্স কমে আসার আশঙ্কায় ডলার কিনে ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রেখেছে। এতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের গতি বাড়েনি।
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।
আমানতের প্রবৃদ্ধিতে ধস
ব্যাংক খাতের আমানত প্রবৃদ্ধি আবার কমতে শুরু করেছে। মে শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮.৭৪ শতাংশে, যা মার্চে ছিল ৯.৫১ শতাংশ। ১৬টি ব্যাংকে আমানত কমেছে, যার মধ্যে রয়েছে—বেসিক, সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম, আইসিবি ইসলামিক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ন্যাশনাল, বাংলাদেশ কমার্স, মধুমতি, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ব্যাংক।
আমানতকারীদের আস্থাহীনতায় রেকর্ড ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা এখন ব্যাংকের বাইরে রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সামর্থ্যে।
ভারসাম্যই এখন মূল চ্যালেঞ্জ
মূল্যস্ফীতি কমলেও বিনিয়োগ, ঋণপ্রবাহ ও আমানত প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো— মুদ্রানীতিতে কীভাবে ভারসাম্য আনা যায়। বিনিয়োগবান্ধব অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রক নীতিই এখন সময়ের দাবি। এমন বাস্তবতায় নতুন মুদ্রানীতির দিকে তাকিয়ে আছে পুরো অর্থনীতি।